

ঢাকার এক মেসে রাত তখন প্রায় আড়াইটা। জানালার ফাঁক গলে বাইরের হালকা আলো ঘরে ঢুকছে। ছোট টেবিলের সামনে বসা মৃদুল চোখ মুছছে বারবার। সামনে খোলা নোটবুক, হাতে হাইলাইটার। চোখের নিচে কালি, মুখে অবসন্নতার ছাপ। তবু বই বন্ধ করার সাহস পাচ্ছে না তিনি। সামনে যে ৪৭ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি।
এমন দৃশ্য শুধু ঢাকায় নয়, দেশের অনেক শহরে এখন প্রায় একই রকম। কোথাও কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুমে পড়ছেন, কোথাও আবার একতলা ভাড়া বাসার বারান্দায় বসে। সময় যত ঘনিয়ে আসছে, চাপও তত বাড়ছে। একদিকে নিজের স্বপ্ন—অন্যদিকে পরিবারের প্রত্যাশা।
প্রতিযোগিতার নাম বিসিএস—
বিসিএসকে নিয়ে আমাদের সমাজে একধরনের বিশেষ আবহ আছে। গ্রামে আত্মীয়রা খোঁজ নেন, ‘পড়াশোনা শেষ? তাহলে বিসিএস দিবি কবে?’ শহরে মা-বাবা সন্তানকে ডাক্তারের মতোই আরেকটি নাম শোনাতে চান, ‘ক্যাডার’। এই প্রত্যাশা একজন তরুণ-তরুণীর জন্য যেমন প্রেরণা, তেমনি মানসিক চাপেরও উৎস।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বিসিএসে আবেদন করেন কয়েক লাখ পরীক্ষার্থী। কিন্তু প্রথম ধাপ, প্রিলিমিনারি—পেরোতে পারেন কয়েক হাজার মাত্র। ৪৪ তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর বিপরীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মাত্র ১৫ হাজার ৭০৮ জন পরীক্ষার্থী। সংখ্যার এই বিশাল ফারাকই বোঝায় প্রতিযোগিতা কতটা তীব্র।
৪৪ তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘প্রিলিমিনারি হলো একধরনের ছাঁকনি। এখানে জ্ঞান যেমন জরুরি, তেমনি ঠান্ডা মাথা আর সময় ব্যবস্থাপনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
শেষ মুহূর্তের পড়া—
পরীক্ষার একেবারে আগের দিনগুলোতে পরীক্ষার্থীদের পড়ার ধরন বদলে যায়। নতুন বই কেনা বা নতুন টপিক শুরু করার সময় তখন নয়। বরং যা পড়া হয়ে গেছে, সেটাকেই ছোট ছোট নোটে ঝালিয়ে নেওয়াই মূল কৌশল। বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম, ইংরেজির টেন্স, ম্যাথের অনুপাত—সবকিছুর সারসংক্ষেপ খাতায় টুকে রাখেন অনেকে।
বিগত বিসিএসের প্রশ্নপত্র এ সময় সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। এতে বোঝা যায়, কোন বিষয় থেকে কী ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে। অনেকেই বলেন, আগের প্রশ্ন ভালোভাবে পড়লে আসলে অর্ধেক প্রস্তুতিই হয়ে যায়।
আরেকটি বড় বিষয় হলো, মডেল টেস্ট। পরীক্ষার হলের মতো পরিবেশ তৈরি করে সময় ধরে বসলে বোঝা যায়, আসল হলে চাপ সামলানো কতটা সম্ভব। তবে নম্বর নিয়ে অতিরিক্ত হতাশ হওয়া বা আত্মতুষ্ট হওয়ার কোনো মানে নেই—এগুলো কেবল অনুশীলন মাত্র।
মানসিক চাপ ও পরিবারের প্রত্যাশা—
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপের বড় অংশই আসে পরিবার থেকে। কেউ পরিবারকে আর্থিকভাবে দাঁড় করাতে চান, কেউ আবার আত্মীয়স্বজনের চোখে সাফল্যের প্রতীক হতে চান। অনেকের কাছে বিসিএস মানেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই পরীক্ষার সময় সামান্য অসাবধানতাও বড় অস্থিরতা তৈরি করে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এই চাপ সামলাতে সবচেয়ে জরুরি হলো সঠিক রুটিন মেনে চলা। পর্যাপ্ত ঘুম, কিছুটা শরীরচর্চা আর নিয়মিত বিরতি—এসব মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
আগের রাতের আবহ—
পরীক্ষার আগের রাত একেবারেই আলাদা। কেউ তখনো নোটে চোখ বোলাচ্ছেন, কেউবা ঘুমের চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। অভিজ্ঞদের পরামর্শ, এই রাতে বেশি পড়ার চেয়ে শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া বেশি দরকার। কারণ, মাথা যদি ক্লান্ত হয়ে যায়, পরদিন হলে গিয়ে কোনো পড়াই মনে থাকবে না।
অ্যাডমিট কার্ড, কলম, পরীক্ষাকেন্দ্রের তথ্য—এসব গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়াটাই আসল। আরেকটা বিষয় হলো সময়মতো ঘুম। রাত ১০টার মধ্যে বই বন্ধ করে বিছানায় যাওয়া, ভোরে উঠে শুধু নোটে হালকা চোখ বুলিয়ে নেওয়াই শ্রেয়।
পরীক্ষার সকালে—
পরীক্ষার দিন সকালে অনেকের মনেই দোলা দেয় অস্থিরতা। কারও মনে হয়, আরেকটু সময় পেলে ভালো হতো। কেউ আবার আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কিন্তু অভিজ্ঞরা বলেন, একেবারে সকালে নতুন কিছু মুখস্থ করার দরকার নেই। বরং হালকা নাশতা, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হওয়াই উচিত।
ঢাকার রাস্তায় যানজট চিরাচরিত সমস্যা। তাই পরীক্ষার অন্তত আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে পৌঁছানোই নিরাপদ। হলে ঢোকার আগে বাবা-মায়ের দোয়া নেওয়া কিংবা মনকে শান্ত করতে প্রার্থনা করা—এসব ছোট ছোট বিষয় পরীক্ষার্থীদের মানসিকভাবে স্থির করে তোলে।
হলে ঢোকার মুহূর্ত—
পরীক্ষার হলে ঢুকে প্রথমেই অনেকেই চারদিকে তাকায়। কারও মুখে অস্থিরতা, কারও মুখে প্রত্যাশা। সবার হাতে একই প্রশ্নপত্র, কিন্তু মানসিক অবস্থা একেকজনের একেক রকম।
এ সময়ই আসল পরীক্ষা। উত্তরপত্রের নির্দেশনা মনোযোগ দিয়ে পড়া, সেট কোড সঠিকভাবে ভরাট করা, সহজ প্রশ্ন আগে সমাধান করা—এসব ছোট ছোট সিদ্ধান্তেই নির্ধারিত হয় ফলাফল। মেহেদী হাসান বলেন, ‘প্রশ্নপত্র দেখে ভয় পেয়ে গেলে সব শেষ। বরং যেটা জানা আছে, সেটা আগে করে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো উচিত।’
প্রশ্নের সংখ্যাও এখানে বড় বিষয়। আন্দাজে উত্তর দিলে নেগেটিভ মার্কিংয়ের ঝুঁকি থাকে। তাই ২০০ প্রশ্নের মধ্যে ১৬০-১৬৫ সঠিক উত্তর করাই যথেষ্ট।
বিসিএসের মানসিক ল্যান্ডস্কেপ—
প্রতিবছর বিসিএস শুধু একটি পরীক্ষা নয়, বরং একটি প্রজন্মের স্বপ্নের গল্প। কোনো পরিবারে ছেলে বা মেয়ে ক্যাডার হলে পুরো গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে। আবার ব্যর্থতার হতাশাও বড় এক বাস্তবতা।
তবে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা একটাই, শেষ মুহূর্তে চাপ না নিয়ে ঠান্ডা মাথায় খেলা। কারণ, প্রিলিমিনারি পেরোনো মানে এখনো পথের শুরু, সামনে লিখিত আর মৌখিক—আরও কঠিন ধাপ অপেক্ষা করছে।
শেষের শুরু—
বিসিএস কেবল চাকরিতে প্রবেশ নয়, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ধাপ। তাই এই পরীক্ষার প্রস্তুতিও হতে হবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। শেষ মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর তিনটি শব্দ—রিভিশন, অনুশীলন ও আত্মবিশ্বাস।
আর একটি বিষয় প্রতিটি কাজে সফল হতে হলে সৎ মনোবৃত্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। অসৎ পথে সর্বনাশ। যাঁরা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে চাইছেন, তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, মৃদুলরা আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে সততার চর্চা করবেন।
৪৭ তম বিসিএসের হলে বসা লাখো তরুণের জন্য শেষ কথাটিই হয়তো হয়ে উঠতে পারে অনুপ্রেরণার মূলমন্ত্র।