

জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ শেষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর জবানবন্দি দেন। পরে ট্রাইব্যুনাল আগামী সোমবার আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জেরার দিন ধার্য করেন।
গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। গতকাল ২৫তম কার্যদিবসে সাক্ষ্য দেন ৫৪তম সাক্ষী। মামলার বাকি দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ৫৪তম সাক্ষীর জবানবন্দির মাধ্যমে বিচারের দুই ধাপ শেষ হলো। তদন্ত কর্মকর্তার জেরা শেষে উভয় পক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে। এরপর মামলটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হবে।
তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর জবানবন্দিতে ৯২টি ডকুমেন্টস, ৬০টি তথ্য-প্রমাণসহ প্রায় ১৪ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্টারি এবং এভিডেন্স দাখিল করেছেন। প্রসিকিউশন মনে করে, শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করা হয়। গত ২ জুলাই এ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। জুলাই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় নভেম্বরের মধ্যে রায় হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল তৃতীয় দিনের মতো জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর গণঅভ্যুত্থানের সময় বিবিসি বাংলা, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত চারটি ভিডিও এবং তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। এসব প্রামাণ্যচিত্রে আন্দোলন দমনে নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সরকারদলীয় সশস্ত্র ক্যাডাররা কমপক্ষে ৪১ জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। অর্ধশতাধিক জেলায় আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আন্দোলনকারী সবাই ছিল নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এনটিএমসির মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোবাইল ট্র্যাকিং, ড্রোন ব্যবহার করে তাদের ওপর হত্যা, জখম, গ্রেপ্তার-আটক চালায়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা ছিল পদ্ধতিগতভাবে এবং সাধারণ মানুষের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক নিপীড়ন।
আলমগীর বলেন, তদন্তে জুলাই আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকার যত খুন, জখম, অপহরণ ও নির্যাতন করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা। গত ১৫ বছর ধরেই হত্যা, খুন, জঙ্গি নাটক, জোরপূর্বক অপহরণ, পাতানো নির্বাচনসহ সরকারের সবকিছুর মূলে ছিল ক্ষমতা ধরে রাখা। আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সব ধরনের অপকৌশল করেছে। এ কারণে ২০২৪ সালের আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তৎকালীন সরকার পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং মিডিয়ার ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, জুলাইয়ে হত্যাকাণ্ড বা নৃশংসতা চলল– এসব বন্ধে আসামিরা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিনা? আপনি তদন্তে এমন কিছু পেয়েছেন কিনা? জবাবে আলমগীর বলেন, না, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড-নৃশংসতা বন্ধে আসামিরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। যারা হত্যা-গুম ও জখম জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি।
জবানবন্দির এক পর্যায়ে জব্দ বিবিসি বাংলা ও আলজাজিরায় প্রচারিত অনুসন্ধানী ভিডিও প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। এসব ভিডিওতে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকোথন, সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের কথোপকথন, রংপুরে আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী ডা. রাজিবুল ইসলামের মন্তব্যসহ বেশ কয়েকটি শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার, আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, তাদের ওপর ভয়াবহ হামলা, দমন-পীড়ন, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণসহ অন্যান্য দৃশ্য উঠে এসেছে।
ট্রাইব্যুনালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন উপস্থিত ছিলেন। বরাবরের মতো গতকালও বিচার কার্যক্রম বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন মিজানুল ইসলাম ও গাজী এম এইচ তামিম। আগামী সোমবার তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করবেন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
গত ১০ জুলাই তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।