

কাঁটাতারের এক পাশে আনন্দবাস, অন্য পাশে হৃদয়পুর। নদীয়ার চাপড়া থানাধীন হৃদয়পুর গ্রামে আমাদের বাড়ি আর মুজিবনগরের আনন্দবাস গ্রামে খালার বাড়ি। শুধু খালার বাড়িই না, আমাদের আরও অনেক আত্মীয়ও এই গ্রামে থাকেন। ছোটবেলায় এখানকার মতো সীমান্তে এত কড়াকড়ি ছিল না, কাঁটাতারের বেড়াও ছিল না। ভালো কিছু রান্না হলেও খালা আমার জন্য বাটিতে করে ওপারে আমাদের বাড়িতে পাঠাতেন। আমরাও পাঁচ ভাইবোন সময় পেলেই এখানে বেড়াতে আসতাম। পাশাপাশি দুই গ্রামের মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করত, বিয়েশাদিও ছিল স্বাভাবিক।
১৯৯৫ সালে আমার যেমন এপারে আনন্দবাস গ্রামে বিয়ে হয়ে যায়। আমি তখন স্কুলে পড়ি। পাত্র খালার বাড়ির পাশের রবিউল ইসলাম। বিয়ের পাঁচ বছর পর আমার বড় মেয়ের জন্ম। আস্তে আস্তে সংসার বড় হতে থাকে, ব্যস্ততাও বাড়ে। মন চাইলেই আর হৃদয়পুরে যাওয়া হয় না।
আস্তে আস্তে সীমান্তে কড়াকড়িও বাড়ে। একসময় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করা হয় দুই গ্রাম। তখন আর মন চাইলেই আত্মীয়স্বজনের মধে৵ দেখা হতো না। মাকে দেখতে ইচ্ছা হলে খবর পাঠাতাম। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সীমান্তের কাছে মাঠে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা হতো। ঘাস কাটার ছলে মা কাঁটাতারের কাছে জমিতে আসতেন, আমি এপাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম, দূর থেকে একে অন্যকে দেখতাম। অনেক বছর ধরে সেই সুযোগও নেই, তাই মায়ের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়নি।
এক বছর ধরে মা অসুস্থ ছিলেন। ফোনে বা ভিডিও কলে তাঁর সঙ্গে কথা হতো। শেষ দিকে প্রায়ই পাসপোর্ট-ভিসা করে ভারতে গিয়ে তাঁকে দেখে আসতে বলতেন; কিন্তু করছি, করব করে আর পাসপোর্ট করা হচ্ছিল না।
কীভাবে ওপারে যাই
৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে খবর এল, মা আর নেই। ছুটে যাই সীমান্তের কাছে। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ার পাশে বসে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। আমার পাসপোর্ট ও ভিসা নেই, কীভাবে ওপারে যাই? স্বামী-সন্তানেরা বাড়িতে আনল। কাঁদতে কাঁদতে রাত পার হয়ে গেল।
সকালে আমার স্বামী মুজিবনগর বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে বিষয়টি জানালেন। শেষবার মাকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। আগেও সীমান্তে দুই পরিবারের সদস্যদের শেষবার দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিজিবি কর্তৃপক্ষ মানবিকভাবে বিষয়টা নিয়ে ভারতের বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারাও ইতিবাচক সাড়া দিল।
সকাল ১০টার দিকে মাকে সীমান্তে আনা হলো। ছুটে গিয়ে দেখি, খাটিয়ায় সাদা কাফনে মোড়ানো মায়ের নিথর দেহ। বুকটা ফেটে গেল। সব শক্তি হারিয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছিল, মা একবার চোখ খুলে তাকাবেন। কিন্তু তিনি চুপচাপ শুয়েই রইলেন। সেই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মেয়ে।
বিজিবি–বিএসএফের কারণে শেষবার মায়ের মুখটা তো অন্তত দেখতে পেরেছি। তবে আফসোস রয়ে গেছে—বেঁচে থাকতে মায়ের মুখটা দেখা হলো না, মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারলাম না, ‘মা, আমি এসেছি।’