শিক্ষা ক্যাডারে বাড়ছে চাপ, উদ্বেগ কর্মকর্তাদের


রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হলে এসব কলেজে কর্মরত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অন্তত দেড় হাজার সদস্যকে ঢাকার বাইরে বদলি হতে হবে। এতে শিক্ষা প্রশাসনে কর্তৃত্ব হারানোর শঙ্কায় পড়েছে বিসিএসের সবচেয়ে বড় ক্যাডার। এর প্রতিবাদে সরব হয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

শিক্ষা ক্যাডারের কর্তৃত্ব হারানোর ঘটনা ঘটেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডেও (এনসিটিবি)। বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রতিষ্ঠানটি। তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছেপে থাকে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এনসিটিবির মাধ্যমে তারা আর প্রাথমিকের বই ছাপাবে না। তারা নিজেরাই সরাসরি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বই ছাপানোর কাজ সম্পন্ন করবে।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মাউশির মহাপরিচালক। এই পদের বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান পদে বহাল থাকা অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এই পদে যোগ্য লোক খুঁজতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এতে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ইতোমধ্যে মহাপরিচালক নিজের অব্যাহতি চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পত্র দিয়েছেন।

শিক্ষা ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা সত্যের পথকে বলেন, মাউশি মহাপরিচালক পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয় না। এ পদে ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মধ্য থেকে পদায়ন করা হয়। তাই এই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়, পদায়নে নয়।

সাম্প্রতিক সময়ের এসব ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকায় শিক্ষা প্রশাসনে কর্তৃত্ব ও মর্যাদা হারানোর আশঙ্কায় তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে মাউশিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা এবং প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিপিই) দেওয়ার প্রস্তাব ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র বিতর্ক।

শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারির ডিসি সম্মেলনে জেলা প্রশাসকরা মাউশি ভেঙে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের প্রস্তাব দেন। তখন ব্যাপক বিতর্ক ও শিক্ষা ক্যাডারের আপত্তির মুখে প্রস্তাবটি স্থগিত হয়। কিন্তু আড়াই বছর পর সেই পুরোনো প্রস্তাব আবার সামনে এনেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার ও তৎকালীন শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়ের স্বাক্ষরিত সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয় ও তা সরকারপ্রধানের অনুমোদন পায়।

এদিকে, সরকার এনসিটিবি আইন ২০১৮ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে ২০২৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার দায়িত্ব পাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে আইন সংশোধনের খসড়া প্রকাশ করে মতামত চেয়েছে।

শিক্ষাবিদদের মতে, পাঠ্যবই মুদ্রণ একটি বিশেষায়িত ও জটিল প্রক্রিয়া, যা অনেক বছর ধরে এনসিটিবি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে। ডিপিই এখনই এ দায়িত্ব নিলে কারিকুলাম, মাননিয়ন্ত্রণ ও বই সরবরাহে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

অবশ্য ডিপিই কর্মকর্তারা যুক্তি দিচ্ছেন, প্রাথমিকের বই ছাপানোর বাজেট বরাদ্দ তাদের মন্ত্রণালয় থেকেই দেওয়া হয়; তাই সরাসরি বই ছাপালে অর্থ ও সময় দুটোই সাশ্রয় হবে। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, এটি তাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগের সুযোগ কমিয়ে দেবে।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটির সভাপতি এস এম কামাল আহমেসত্যের পথকে বলেন, অংশীজনের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তুলে এই বিভাজন রোধ করা হবে।

বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, শিক্ষা সবচেয়ে বড় ক্যাডার। বিভক্তির সিদ্ধান্ত তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা বাড়াবে।

বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারে ১৯ হাজার ৮৬৮টি পদের বিপরীতে সাড়ে ১৭ হাজার কর্মকর্তা কর্মরত। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের আরেক বড় সংকট পদোন্নতি ও তৃতীয় গ্রেডের অভাব। গত ১৭ মাস ধরে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি পদোন্নতির দাবিতে মাউশি কার্যালয়ে একাধিক দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন এই ক্যাডারের ৩২ ও ৩৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা।

ঢাকা কলেজের এক সহযোগী অধ্যাপক বলেন, প্রশাসন ক্যাডার শিক্ষা ক্যাডারকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা করছে।

শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতে, শিক্ষা ভবনে বিভাজন হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতা তৈরি হবে, নীতি-নির্ধারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হবে।

বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, শিক্ষাকে বিভক্ত করে মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো পরিবর্তন করলে তার ফল হবে নেতিবাচক।

Leave a Reply

Scroll to Top