রাজধানীর রাস্তায় আবারও ফিরছে বিলবোর্ড

দশ বছর আগে ঢাকা বিলবোর্ডমুক্ত করা হয়েছিল। আয় বাড়ানোর অজুহাতে আবার তা ফিরিয়ে আনছে দুই সিটি করপোরেশন। বিজয় সরণি এলাকায় ভাড়া দেওয়ার জন্য তৈরি বিলবোর্ডের সারি -সত্যের পথে

গত অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব তুলতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এবার আয় বাড়ানোর ছুতায় আবার বিলবোর্ড ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছে নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থা দুটি। তবে প্রায় এক দশক আগে নগর পরিকল্পনাবিদদের চাপের মুখে রাজধানী বিলবোর্ডমুক্ত করা হয়েছিল।

এরই মধ্যে সড়ক বিভাজক, গোলচত্বর ও সুবিধাজনক স্থানে ডিজিটাল বিলবোর্ড বসাতে সংশ্লিষ্টদের অনুমতিও দিয়েছে সিটি করপোরেশন। তবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এ কাজ দেওয়া হয়নি। কোন কোন প্রতিষ্ঠান এই কাজ পেয়েছে, তাও গোপন রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অরণ্য প্রাইভেট লিমিটেড ও চেরী আর্ট নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে পেরেছে সত্যের পথে। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে পাওয়া গেলেও তিনি নাম-ঠিকানা জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

শুধু সড়ক বা গোলচত্বর নয়, মেট্রোরেলের পিলারে (খুঁটি) ডিজিটাল বিলবোর্ড লাগানোর কাজ চলছে মহাসমারোহে। তবে মেট্রোরেল পিলারের সড়ক বিভাজকে শুধু সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ থাকার কথা ছিল। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের দাবি, নিচে সড়ক বিভাজকের তদারকির দায়িত্ব তাদের হলেও সিটি করপোরেশন নিয়ম ভেঙে বিলবোর্ড স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যে কোনো বিলবোর্ড নগরের সৌন্দর্যহানির পাশাপাশি যানবাহন চলাচলে ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে মেট্রোরেলের কম উচ্চতার খুঁটিতে যেসব বিলবোর্ড লাগানো হচ্ছে, সেখানকার নিয়ন আলো গাড়িচালকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেবাদানকারী সংস্থাকে আগে নাগরিক নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে, এরপর রাজস্ব আয়।

দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এই অর্থবছরে ডিজিটাল বিলবোর্ড বসিয়ে ২৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ডিএনসিসি তিনটি সড়কে বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এরই মধ্যে দিয়েছে এক কোটি টাকায় ডিজিটাল বোর্ড স্থাপনের অনুমতি।

এর আগে ২০১৫ সালে ডিএনসিসির সে সময়ের মেয়র আনিসুল হক এবং ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে শত শত বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। সিটি করপোরেশন তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভবিষ্যতে রাজধানীতে আর বিলবোর্ডের অনুমতি দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে দু-একটি স্থানে ডিজিটাল বোর্ড বা বড় টিভি স্ক্রিনের ডিসপ্লে বোর্ড থাকবে। পরে সীমিত পরিসরে কিছু স্থানে ডিসপ্লে বোর্ড বসানোও হয়। তবে এখন বড় পরিসরে আবার বিলবোর্ড ফিরে এসেছে। এ বিষয়ে উভয় সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলরা মুখ খুলতে নারাজ।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান সত্যের পথেকে বলেন, আগে এ খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি হতো। সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিলবোর্ড বসানোর সুযোগ দিয়ে পকেট ভারী করত। আর সিটি করপোরেশন রাজস্ব পেত কম। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আশা করেছিলাম, ঢাকা নগরী আরও সুন্দর হবে। তবে দেখা যাচ্ছে, আবার বিলবোর্ড ফিরে আসছে। নগর আরও কুৎসিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিলবোর্ড অ্যাডভার্টাইজিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. রাশেদ সত্যের পথেকে বলেন, কিছু ডিজিটাল বোর্ড ও টিভি স্ক্রিন ডিসপ্লে অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ছিল। তবে আমি দেখছি, শাহবাগে আমার একটি ডিজিটাল বোর্ডের ওপর একটি বড় বিলবোর্ড বসানো হয়েছে। অনুমতি না দিলে সেটি কারা বসাল, তা কেউ বলছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিলবোর্ড অ্যাডভার্টাইজিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশন নিয়মনীতি ছাড়াই বিউটিফিকেশনের নামে দেদার এলইডি স্ক্রিন, ডিসপ্লে বোর্ড, হোর্ডিং স্থাপনের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল পর্যন্ত সড়ক বিভাজকে ছোট আকৃতির বিলবোর্ড বসানোর অনুমতি দিয়েছে ডিএসসিসি।

গত সোমবার দেখা গেছে, মেট্রোরেলের খুঁটিতে কে বা কারা ডিজিটাল বোর্ডের কাঠামো তৈরি করেছে। একই চিত্র দেখা গেছে শেরেবাংলা নগর থেকে খামারবাড়ি পর্যন্ত মেট্রোরেলের নিচের সড়ক বিভাজকে। সেখানে এরই মধ্যে ডিজিটাল বোর্ড বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও খামারবাড়ির গোলচত্বরের চারপাশজুড়ে একই কার্যক্রম চলছে।

মাস র‍্যাপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, বিলবোর্ডের বিষয়ে আমি সিটি করপোরেশনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তবে তারা সরাসরি জানায়নি, সেখানে বিলবোর্ড স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে কিনা।

এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে জানা যায়, কয়েক দিন হলো পদটি শূন্য হয়েছে। সচিব নাছিম আহমেদ দায়িত্বে থাকলেও তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে বিউটিফিকেশন সেলের সদস্য ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে কখনও নগর পরিকল্পনা শাখার মতামত নেওয়া হয় না। তিনিও এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।

এদিকে, তিনটি সড়কদ্বীপ ও সড়ক বিভাজকে সৌন্দর্য বর্ধনের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন বিলবোর্ড লাগানোর অনুমতি দিয়েছে ডিএনসিসি। এই তিনটি সড়কদ্বীপ হলো মিরপুর-১০ থেকে মিরপুর-১৪ হয়ে ক্যান্টনমেন্টের এমপি চেকপোস্ট, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের সড়কদ্বীপ এবং বিজয় সরণি এলাকা। এসব এলাকায় সৌন্দর্য বর্ধনের ছিটেফোঁটা দেখা না গেলেও বিজ্ঞাপনের বোর্ড ঠিকই বসে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই বিলবোর্ডগুলো ডিএনসিসি ট্যাক্সমুক্ত রাখারও সুযোগ দিয়েছে।

বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বেশ কিছু বড় আকৃতির বিলবোর্ড দেখা যায়। সেখানে নানা ধরনের বিজ্ঞাপনও শোভা পাচ্ছে। আবার আগারগাঁও থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত সড়কের পাশেও কিছু বড় আকৃতির বিলবোর্ড দেখা গেছে। এ ছাড়া শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনেও একাধিক বিলবোর্ড রয়েছে। পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কেও বেশ কিছু বিলবোর্ডের অস্তিত্ব মিলেছে।

বিলবোর্ড লাগানোর কাজ পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান অরণ্য প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম সত্যের পথেকে বলেন, ‘কীভাবে আমরা কাজ পেয়েছি, এটি আপনাকে বলা যাবে না।’ ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘টপ ম্যানেজমেন্ট কাজ বণ্টনের ব্যাপারে জানে। আমি কিছু জানি না।’

সরেজমিন দেখা যায়, বিজয় সরণিতে সারি সারি বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া দেওয়ার যোগাযোগ নম্বর দেওয়া হয়েছে। একটি নম্বরে ফোন করলে সাজ্জাদ আহমেদ নামে একজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম বলা যাবে না। আর যতগুলো আছে সব একসঙ্গে ভাড়া দেওয়া হবে। একটি-দুটি দেওয়া হবে না। তাদের কিছু কাজ এখনও বাকি।’

প্রায় একই কথা বলেন শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মেট্রোরেলের গোড়ায় গোড়ায় বসানো বিলবোর্ড প্রতিষ্ঠান চেরী আর্টের কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন। তিনিও প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা জানাতে চাননি। বলেন, ‘শাহবাগ ও কারওয়ান বাজার চৌরাস্তায় বসবে বড় এলইডি স্ক্রিন। আর বাকি ৩৮টা ছোট বিলবোর্ড মেট্রোরেলের দুই খুঁটির মাঝখানে। এখন যেটা খুঁটি ঘেঁষে আছে।’

এসব বিষয়ে গত রোববার ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। পরে মোবাইল ফোন নম্বরে মেসেজ দিয়েও সাড়া মেলেনি।


Leave a Reply

Scroll to Top