
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষার তাগিদ থেকে ‘মীনা’ কার্টুনের জন্ম। শুরুতে শুধু মেয়েশিশুদের অধিকারের কথা বললেও পথপরিক্রমায় সব শিশুরই অধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে ‘মীনা’। বাংলাদেশ টেলিভিশনে মীনা কার্টুন দেখানোর পাশাপাশি রেডিওতেও প্রচারিত হয় মীনা অনুষ্ঠান। মীনার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হিসাব করে ১৯৯৮ সালে ২৪ সেপ্টেম্বরকে ‘মীনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে ‘মীনা’, ‘রাজু’ ও ‘মিঠু’র খোঁজ মিলল। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে তারা আর ভীষণ ব্যস্তও। ‘মীনা’, ‘রাজু’, ‘মিঠু’ অবশ্য ওদের পর্দার নাম। পর্দার আড়ালে থাকা প্রমিতা গাঙ্গুলী, আবরার সাজিদ পাশা ও কামাল আহসানের কণ্ঠ শোনা গেছে পর্দার ‘মীনা’, ‘রাজু’ আর ‘মিঠু’র মুখে। সেটা অবশ্য ৩০ বছর আগে।
মীনা এখন গৃহবধু
‘ও রাজু, তুমি ইশকুলে যাইবা না?’ স্টুডিওতে প্রথম দিন এই সংলাপ দিয়েছিলেন প্রমিতা। ‘মীনা’ চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়া প্রমিতা গাঙ্গুলীকে গতকাল সোমবার বিকেলে পাওয়া গেল। শৈশবে কার্টুনপাগল মেয়েটির অভিনয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এখন আর তিনি বিনোদন জগতে নেই। তবে ‘মীনা’কে নিয়ে তাঁর অভিনয়ের স্মৃতিগুলো আজও জাগরূক। ছোটবেলায় কার্টুন দেখতে দেখতে চরিত্রের মতো কথা বলা রপ্ত করেছিলেন। নিজে নিজেই বলতেন সংলাপ। পরে এক আত্মীয়ের সূত্রে ‘মীনা’ কার্টুনের দলের সঙ্গে পরিচয়। বাবার হাত ধরে চলে যান ধানমন্ডির এক স্টুডিওতে। ২০২১ সাল পর্যন্ত মীনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তত দিনে বড় হয়ে গেলেও কণ্ঠটা রপ্ত করেছিলেন বেশ, সমস্যা হয়নি।
মীনা নিয়ে ভাবনা
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি শেষ করে পড়েছেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। তড়িৎ ও ইলেকট্রিক প্রকৌশলের ডিগ্রি নিয়েছেন। পরে ইউল্যাব থেকে এমবিএ করেন। মাঝখানে বেশ কিছুদিন একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তবে এখন গৃহিণী, সন্তানকে সময় দিচ্ছেন। সন্তান একটু বড় হলে তখন কিছু একটা করার পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে স্বামীর চাকরিসূত্রে গাজীপুরে থাকেন। প্রমিতা জানান, স্কুলজীবন থেকেই অনেকে তাঁকে ‘মীনা’ বলে ডাকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্যাম্পাসেও ‘মীনা’ ডাক শুনতে হয়েছে।

নানা দেশে ‘মীনা’
এ নিয়ে দুই–একবার রাগারাগির মতো ঘটনাও ঘটেছে। ক্যাম্পাসে ‘মীনা’, ‘মীনা’ বলে খেপানোর কারণে নালিশও করেছেন শিক্ষকের কাছে। ‘আমি নিজেকে সত্যিই মীনা ভাবি। মীনার দর্শন ধারণ করি, কোনো অন্যায় বা বৈষম্য দেখলে যুক্তিসহকারে উত্তর না দিয়ে পারি না,’ বলেন প্রমিতা।

আবরার ‘রাজু’ সাজিদ
সারা গ্রামে ছোটাছুটি করা ‘রাজু’র কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। মীনার ছোট ভাই। সব ধরনের দুষ্টুমিতে মীনাকে মাতিয়ে রাখে রাজু। ‘রাজু’র ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছেন আবরার সাজিদ পাশা। গতকাল শেষবেলায় আবরার সাজিদকে পাওয়া গেল।
লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। অরণি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় মীনার সঙ্গে যোগ দেয় রাজু তথা আবরার। স্কুলে এসেছিল ‘মীনা’ কার্টুনের দল। তখন অডিশন দিয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন আবরার। প্রথম দিনের সংলাপগুলো মনে আছে স্পষ্ট, ‘চিন্তা কইরো না, জাদুর পাথর খুঁইজা পাইতে আমরা তোমারে সাহায্য করুম’, ‘মীনা, সত্য সত্যই কি এলিয়েন আছে?’
টানা ১০ বছর মীনা দলে যুক্ত ছিলেন আবরার। টেলিভিশন ও বেতারে কণ্ঠ দিয়েছেন। পুরোনো বন্ধুদের অনেকেই এখনো তাঁকে ‘রাজু’ বলে ডাকেন। ‘মীনা’র সংলাপ শোনানোর জন্য অনুরোধ করেন। অবশ্য এখনকার বন্ধুরা তাঁর এই অধ্যায়ের কথা জানেন না। প্রথম শ্রেণিতে পড়া সেই ছেলে সেন্ট যোসেফ থেকে উচ্চামাধ্যমিক সেরে এখন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত। আপাতত বিনোদন জগতে কাজের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে সাংবাদিকতা বা লেখালেখিতে আগ্রহ আছে। সবই করবেন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করে। সেদিক থেকে মূল লক্ষ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ করা। স্বপ্ন—রাষ্ট্রদূত হবেন।
‘মিঠু’ই শুধু অভিনয়ে ব্যস্ত
‘আমার নাম মিঠু’—মিনা কার্টুনের এই সংলাপই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। আজও অনেকে শিশুদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে সংলাপটি ব্যবহার করেন। মীনা সিরিজের তিন মূল চরিত্রে একমাত্র মিঠুর কণ্ঠদানকারীই পেশাদার অভিনয়শিল্পী। গতকাল দুপুরে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন অনেকটা মজা করেই নিজের পরিচয় দেন ‘মিঠু’র মতো করে, ‘আমার আসল নাম কামাল আহসান।’
জনপ্রিয় মোটু–পাতলু সিরিজের ‘মোটু’, ‘জন’সহ তিনটি চরিত্রের কণ্ঠ তিনি দিয়েছেন। এসব চরিত্রের সংলাপও শোনালেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুস্তাফা মনোয়ারের জনপ্রিয় মনের কথা ধারাবাহিকে ‘বাউল’, ‘ষাঁড়’সহ বেশ কিছু চরিত্রের কণ্ঠও তাঁর। মীনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই অভিনেতা জানান, তখন সুবচন নাট্যদলে কাজ করতেন।

পাশাপাশি ১৯৯০ সাল থেকে চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারে সঙ্গে পাপেট শো করতেন। ১৯৯৫ সালে ‘মীনা’ কার্টুনের কাজ শুরু করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে কণ্ঠধারণ হতো। পাখির কণ্ঠে কথা বলাটা একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা। সে সময় দিনের পর দিন টিয়া পাখির চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করতেন। একটা পাখি কেমন করে বসে, কেমন করে খায়, কেমন করে ডানা ঝাপটায়, বাতাস এলে কী করে, সর্বোপরি নিজেকে পাখির মতো ভাবতে থাকেন।
সংগত কারণেই সে সময় তাঁদের কেউই চিনত না। কয়েক বছর আগে মীনা দিবসের এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে এনে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তখন উপস্থিত দর্শকের করতালি আর শুভেচ্ছায় বুঝতে পারেন, মানুষের মনে এখনো সেই কণ্ঠের সুবাদে তাঁদের জায়গা আছে। কোনো আয়োজনে কেউ যখন জানতে পারেন যে কামালই ‘মীনা’ কার্টুনের ‘মিঠু’, তখন আবদার করেন, ‘একটু মিঠুর মতো করে বলেন তো!’ কামালও তখন আনন্দ নিয়ে শোনান, ‘আমার নাম মিঠু’।
তাঁর ভাষ্য, ‘আসলে মানুষকে আনন্দ দিতে পারছি, একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারছি, এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। মিঠুর চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়াটা আমার জীবনের একটা বড় ঘটনা।’ আগামী সময়েও অভিনয় পেশায় নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছা কামাল আহসানের।
শেয়ার করুন:
- Click to share on Facebook (Opens in new window) Facebook
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window) WhatsApp
- Click to share on Telegram (Opens in new window) Telegram
- Click to email a link to a friend (Opens in new window) Email
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window) LinkedIn
- Click to share on Threads (Opens in new window) Threads