

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার উদ্যোগে তাঁর পূর্ণ সমর্থনের অঙ্গীকার ও সংহতি ব্যক্ত করেছেন। স্থানীয় সময় গত সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ অঙ্গীকার করেন। বৈঠকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া এবং এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিবের মধ্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত নৃশংসতার দায় নিরূপণ, সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য উদ্বেগ এবং আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপ এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতের অঙ্গীকার মহাসচিবকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন আয়োজনে আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
ড. ইউনূস অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুত শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসররা চুরি করা অর্থ ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন চায় না। কিছু আন্তর্জাতিক মহলও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
জবাবে আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জাতিসংঘের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘের ধারাবাহিক ভূমিকার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি গত ১৪ মাস ধরে প্রধান উপদেষ্টার প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। গুতেরেস জানান, বাংলাদেশের এ কঠিন উত্তরণ প্রক্রিয়ায় তাঁর নেতৃত্বকে তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ৩০ সেপ্টেম্বর উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলন আহ্বান করার জন্য মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এ সম্মেলন রোহিঙ্গা সংকটকে বৈশ্বিক আলোচনায় অগ্রাধিকারে এবং আশ্রয় শিবিরে মানবিক সহায়তার জন্য জরুরি তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখবে। জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
ইউনিসেফ ও ইউএনএইচসিআর-প্রধানের সাক্ষাৎ, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে একটি হোটেলে সাক্ষাৎ করেছেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল। এ সময় আলোচনায় বাংলাদেশের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার জন্য মানবিক কার্যক্রমে তহবিল ঘাটতির বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এই তহবিল কমে যাওয়া শিবিরের রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষাসেবায় বড় প্রভাব ফেলবে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা তহবিল সংকটকে গুরুতর চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেন, এর কারণে বহু স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এটি বড় ধরনের বিপর্যয়। শিবিরের শিক্ষা ব্যবস্থা হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জীবনে নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক রাসেল বৈশ্বিক তহবিল পরিস্থিতি কঠিন বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, প্রথাগতভাবে উদার হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় দেশগুলোও ইউনিসেফের মতো সংস্থার মানবিক তহবিলে অর্থ দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান রোহিঙ্গা যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে, যাতে তারা শেষ পর্যন্ত সেই দক্ষতা দেশে ফিরে ব্যবহার করতে পারে।
সাক্ষাতে উপস্থিত ইউনিসেফের উপ-নির্বাহী পরিচালক টেড চাইবান রোহিঙ্গা শিবিরে শিক্ষার ইতিবাচক প্রভাবের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
একই দিন জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্রান্ডি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আগে সংস্থাটির সদরদপ্তরে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে উভয় নেতাই সংকটের মূল বিষয়গুলো নিয়ে গভীর আলোচনা করেন। এর মধ্যে ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্রমশ অবনতিশীল মানবিক পরিস্থিতি, কক্সবাজারে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ওপর প্রভাব ফেলে এমন আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস এবং রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই একমাত্র কার্যকর সমাধান: ইউএন বিশেষ দূতকে প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, রোহিঙ্গা জনগণকে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন করাই এ দীর্ঘস্থায়ী সংকটের একমাত্র কার্যকর সমাধান। এর কোনো বিকল্প নেই। সোমবার নিউইয়র্কে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
বৈঠকে তারা রোহিঙ্গা সংকট, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল ঘাটতি এবং মঙ্গলবারের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আলোচনা হতে যাওয়া সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ড. ইউনূস বলেন, ‘আশা করি, মঙ্গলবার অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে কিছু কার্যকর প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। এটি এমন একটি বিষয়, যা বিশ্বের অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।’ খবর বাসসের।