

৩ সেপ্টেম্বর ৭৩ বছরে পা দিয়েছেন শক্তি কাপুর। খলনায়ক থেকে কৌতুক অভিনেতা হয়ে ওঠার গল্প, প্রেমে পড়ে পালিয়ে বিয়ের কাহিনি, আর ২০০৫-এর বিতর্ক—সব মিলিয়ে ঘটনাবহুল জীবন এই অভিনেতার। নানা উত্থান-পতন পেরিয়েও তিনি আজও বলিউডের জনপ্রিয় মুখ। দর্শকের মনে তিনি অমলিন—কখনো ভয়ংকর খলনায়ক, কখনো অদ্ভুত মজার কৌতুক অভিনেতা। রইল তাঁর জীবনের গল্প।
মুম্বাইয়ের বান্দ্রা এলাকার লিংকিং রোডে ঘটে এক ঘটনা, যা তরুণ শক্তি কাপুরের জীবনকে এক মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মূলত দুর্ঘটনা। তরুণ শক্তি কাপুর আর সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফিরোজ খানের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। শক্তি কাপুর চালাচ্ছিলেন তাঁর পুরোনো ১৯৬১ সালের ফিয়াট। আর ফিরোজ খান সদ্য কেনা ব্র্যান্ড নিউ মার্সিডিস। সংঘর্ষের পর গাড়ি থেকে নেমে মারমুখী ভঙ্গিতে শক্তি কাপুর ছুটে গেলেন বিপরীতমুখী গাড়ির সামনে। সেই গাড়ি থেকে নামলেন ফিরোজ খান। তাঁকে দেখে শক্তি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, ‘স্যার, আমি শক্তি কাপুর। ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে এসেছি। মডেলিং করি, অভিনয় পারি। আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। দয়া করে আপনার ফিল্মে আমাকে একটা রোল দেবেন?’
আমিই তো সেই বদমাশ
সে সময় ফিরোজ খান ‘কোরবানি’ ছবির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি নিজেই প্রযোজক ও পরিচালক। সেদিন দুর্ঘটনাস্থলে ফিরোজ খান ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি।
ভিড় জমে যাওয়ার পর তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। অফিসে গিয়ে চিত্রনাট্যকার কে কে শুক্লাকে ফোন করে জানালেন পথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা। বললেন, ‘ছেলেটাকে (শক্তি কাপুর) ভয়ংকর লাগছিল!’
এই ছেলেকেই খলনায়ক হিসেবে নিতে চান তিনি। লেখক কে কে শুক্লার সঙ্গে শক্তি কাপুরের আগেই কথা হয়েছিল। ফিরোজ খানের কথা শুনে তিনি শক্তি কাপুরকে বললেন, ‘তোমার ভাই কপালটাই খারাপ। তোমার কথাই বলেছিলাম ফিরোজ সাহেবকে। কিন্তু ফিরোজ ভাই আজ কোনো এক বদমাশের গাড়ির সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। এখন তিনি ওই বদমাশটাকে ভিলেন হিসেবে নিতে চান!’ শুনে শক্তি কাপুর চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘আরে আমিই তো সেই বদমাশ।’

নাম বদলেই খ্যাতি
শক্তিমান অভিনেতা শক্তি কাপুর। বলিউডে তাঁর শুরুটা এ রকমই। আজ গুণী এই অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৫৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, দিল্লিতে তাঁর জন্ম। তাঁর আসল নাম সুনীল সিকান্দারলাল কাপুর। অভিনয়ে আসার পর আরেক অভিনেতা সুনীল দত্ত বড়সড় নামটা বদলে রাখেন ‘শক্তি’। অনেকের মতে, বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির জগতের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ভিলেন। একটা সময় তিনি ছিলেন শুধুই ভিলেন, পর্দায় নায়কদের মার খেয়ে মরে যাওয়া ছিল তাঁর নিয়তি।
এ সময়ের জনপ্রিয় বলিউড তারকা শ্রদ্ধা কাপুর বাবাকে একদিন বলেছিলেন, ‘তুমি কেন সবার হাতে মার খাও? তুমি নায়ক হতে পারো না?’ একমাত্র মেয়ের এ অভিযোগ শুনে বাবা সেদিন হেসেই ফেলেছিলেন।

তাঁর আসল নাম সুনীল সিকান্দারলাল কাপুর। অভিনয়ে আসার পর আরেক অভিনেতা সুনীল দত্ত বড়সড় নামটা বদলে রাখেন ‘শক্তি’।
ভিলেন থেকে কৌতুক অভিনেতা
বছরের পর বছর শক্তি কাপুর ক্রমেই বলিউডের গুরুত্বপূর্ণ খলনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। শক্তি কাপুর সব সময় ভিলেন ছিলেন না। একসময় তিনি হয়ে যান পুরোদস্তুর কমেডিয়ান। মানুষ হাসানোর কাজটি তিনি বেশ ভালোই পারতেন। ‘রাজাবাবু’ ছবির নান্দু, ‘ইনসাফ’-এর ইন্সপেক্টর ভিন্দে, ‘চালবাজ’-এর বাটুকনাথ, ‘বল রাধা বল’-এর গুঙ্গা, কিংবা ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ ছবির সেই বিখ্যাত ক্রাইম মাস্টার গোগোর জন্য ১৯৯৫ সালে পেয়েছিলেন সেরা কমিডিয়ানের পুরস্কার। ভিলেন, কমেডিয়ান বা যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রমাণ করেছেন, অভিনয়ে তিনি শক্তিশালী। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি অভিনেতা কাদের খানের সঙ্গে জুটি বেঁধে শতাধিক চলচ্চিত্রে হাস্য রসাত্মক ও খলচরিত্রে মানিকজোড় হিসেবে কাজ করেছেন।
তাঁর সংলাপ বরাবর আনন্দ দিয়ে আসছে দর্শকদের। ‘আয়া হো, কুচ তো লুটকার জাউঙ্গা-খান্দানি চোর হো ম্যায়, খান্দানি-মোগাম্বো কা ভাতিজা, গোগো’, ‘ক্রাইম মাস্টার গোগো নাম হ্যায় মেরা, আঁখে নিকালকে গোটিয়া খেলতা হো ম্যায়’, ‘জাব কোই বাচ্চা নেহি সোতা, তো উসকা মা ক্যাহতি কি… সো যা, সো যা, নেহি তো গোগো আ যায়ে গা’, এমন অনেক সংলাপ একটা সময় আমাদের দেশেও হিন্দি ছবির দর্শকদের মুখেও শোনা যেত।

ঢাকাই সিনেমায় শক্তি কাপুর
ঢাকার ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা। ২০০০ সালে সাঈদুর রহমান সাঈদের পরিচালনায় ‘এরই নাম দোস্তি’ ছবিতে রিয়াজ-শাবনূরের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তিনি।শ্রদ্ধা কাপুর বাবাকে একদিন বলেছিলেন, ‘তুমি কেন সবার হাতে মার খাও? তুমি নায়ক হতে পারো না?’ একমাত্র মেয়ের এ অভিযোগ শুনে বাবা সেদিন হেসেই ফেলেছিলেন।
পালিয়ে বিয়ে
প্রেম আর পালিয়ে বিয়ে শক্তি কাপুরের ব্যক্তিজীবনও সিনেমার মতো নাটকীয়। ১৯৮০-এর দশকে প্রেমে পড়েন অভিনেত্রী শিবাঙ্গী কোলহাপুরের। কিন্তু শিবাঙ্গীর পরিবার মেনে নেয়নি এই সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত দুজনেই পালিয়ে বিয়ে করেন। প্রথমে শ্বশুর-শাশুড়ির বিরাগভাজন হলেও ধীরে ধীরে মেনে নেন তাঁরা। আজ চার দশকের দাম্পত্য জীবনে শক্তি-শিবাঙ্গী বলিউডের অন্যতম স্থায়ী দম্পতি। তাঁদের দুই সন্তান—অভিনেতা সিদ্ধান্ত কাপুর ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী শ্রদ্ধা কাপুর। বিশেষ করে শ্রদ্ধার সাফল্য শক্তিকে নতুনভাবে আলোচনায় আনে।
কাস্টিং কাউচ
প্রায় চার দশক ধরে সাত শতাধিক ছবিতে অভিনয় করে নিজস্ব একটা পরিচিতি তৈরি করেছেন তিনি। অবশ্য চলার এই পথে নামের সঙ্গে কিছু বদনামও কুড়িয়েছেন শক্তি। ২০০৫ সালে একটি বেসরকারি টিভি সংস্থার স্টিং অপারেশনে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ঘটনাটির অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে সিনেমা এবং টিভির প্রযোজক সংস্থা ‘ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন প্রোডিউসারস গিল্ড অব ইন্ডিয়া’ বাধ্য হয় শক্তিকে বলিউডে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। অভিযোগ শক্তি নাকি কোনো রাখঢাক না করে ওই নারী সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে আগ্রহী।’ সেই কথার রেকর্ডিংও ছিল। শক্তি তাঁকে বলেন, ‘তুমি যদি এই লাইনে (ফিল্ম জগৎ) আসতে চাও, তবে আমি যা বলব, তোমাকে তা-ই করতে হবে।’
পুরো ঘটনাটিই রেকর্ড করছিলেন ওই সাংবাদিক। শক্তিকে এরপর বলতে শোনা যায়, বলিউড জগতের এটাই প্রচলন। পুরো বিষয়টিই রেকর্ড হয়ে যায় ক্যামেরায়। এই ক্লিপিং প্রকাশ্যে আসতেই হইচই পড়ে যায় বলিউডে। অনেকেই বলেছিলেন, এসব বলে শক্তি নিজের ক্ষতি করলেও অজান্তে বলিউডের আসল রূপ প্রকাশ্যে এনে ফেলেছেন। যদিও অভিনেতা পরে বিষয়টিই অস্বীকার করেন। দাবি করেন, ওই সাংবাদিকই তাঁকে এসব বলার জন্য জোর করেছেন। এমনকি আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছেন ওই নারী সাংবাদিক। প্রমাণের অভাবে এরপর শক্তির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় গিল্ড।
নানা উত্থান-পতন পেরিয়েও তিনি আজও বলিউডে সম্মানিত। দর্শকের মনে তিনি অমলিন—কখনো ভয়ংকর খলনায়ক, কখনো অদ্ভুত মজার কৌতুক অভিনেতা।
তিন চড়ে শিক্ষা!
একবার পর্দার এই খলনায়ককে সেটে তিন চড় খেতে হয়েছিল। তার পর বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অভিনেতা। জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘দ্য কপিল শর্মা’ শোতে আসেন শক্তি কাপুরসহ সেই সময়কার আরও দুই বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা। ছিলেন আসরানি, টিকু তালসানিয়া। সেখানেই শক্তি জানান পর্দায় ভয় দেখিয়ে নামডাক ভালোই হয়েছে। এমন সময় ‘সত্তে পে সত্তা’ ছবির প্রস্তাব পান। সেই প্রথম কোনো কৌতুক চরিত্রে অভিনয়। বহু তারকা অভিনীত এই ছবিতে শক্তির অভিনয় প্রশংসিত হয় সেই সময়। তার পরই একটি ছবির প্রস্তাব পান শক্তি। ছবির নাম ‘মাওয়ালি’।

তিন চড়ে শিক্ষা!
একবার পর্দার এই খলনায়ককে সেটে তিন চড় খেতে হয়েছিল। তার পর বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অভিনেতা। জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘দ্য কপিল শর্মা’ শোতে আসেন শক্তি কাপুরসহ সেই সময়কার আরও দুই বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা। ছিলেন আসরানি, টিকু তালসানিয়া। সেখানেই শক্তি জানান পর্দায় ভয় দেখিয়ে নামডাক ভালোই হয়েছে। এমন সময় ‘সত্তে পে সত্তা’ ছবির প্রস্তাব পান। সেই প্রথম কোনো কৌতুক চরিত্রে অভিনয়। বহু তারকা অভিনীত এই ছবিতে শক্তির অভিনয় প্রশংসিত হয় সেই সময়। তার পরই একটি ছবির প্রস্তাব পান শক্তি। ছবির নাম ‘মাওয়ালি’।
চার দশকের ক্যারিয়ারে ৭০০-এর বেশি ছবিতে অভিনয় করে শক্তি নিজের এক অনন্য পরিচয় তৈরি করেছেন। ভিলেন হোক বা ক্রাইম মাস্টার গোগো; পেশাগত সাফল্য বা ব্যক্তিগত সংগ্রাম—শক্তি কাপুর আজও দর্শকের মনে অমলিন হয়ে আছেন, বলিউডের এক শক্তিমান অভিনেতা বললে ভুল হবে না বলে মনে করেন সমালোচকেরা। প্রথম শট দেওয়ার পর থাপ্পড় মারেন কাদের খান। দ্বিতীয়বার থাপ্পড় খেলেন অভিনেত্রী অরুণা ইরানির কাছ থেকে। তৃতীয়বারও আবার চড় খেলেন। এ ঘটনার পর শক্তি ভেবেছিলেন, বলিউড ছেড়ে দেবেন। আর কাজ করবেন না। সেট থেকেই বাড়ি ফিরে যাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সেই সময় শক্তির পাশে দাঁড়ান অজয় দেবগনের বাবা বীরু দেবগন। ‘মাওয়ালি’ ছবির ফাইটমাস্টার ছিলেন তিনি। তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার শুটিংয়ে পাঠান তাঁকে। শক্তি বলেন, ‘বীরুজি ডেকে বলেন, চরিত্রের প্রয়োজনে চড় খেতে হলে খাবে, তাতে লজ্জার কী আছে? ছবিটি পরে সুপার হিট হয় ও আমার অভিনয়ও প্রশংসিত হয়।’

চার দশকের ক্যারিয়ারে ৭০০-এর বেশি ছবিতে অভিনয় করে শক্তি নিজের এক অনন্য পরিচয় তৈরি করেছেন। ভিলেন হোক বা ক্রাইম মাস্টার গোগো, জীবন হোক পেশাগত সাফল্য বা ব্যক্তিগত সংগ্রাম—শক্তি কাপুর আজও দর্শকের মনে অমলিন হয়ে আছেন, বলিউডের এক শক্তিমান অভিনেতা বললে ভুল হবে না বলে মনে করেন সমালোচকেরা।