পরিবেশ সুরক্ষা—ইবাদাতের অংশ

  • কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে পরিবেশ রক্ষা কেবল সামাজিক কর্তব্য নয়, বরং তা আল্লাহর ইবাদতের অংশ। তাই মুসলিম হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সচেতন হওয়া, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক গঠনগত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা ও অতিবৃষ্টির মতো দুর্যোগে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলোর নীতি ও ভোগবাদী সংস্কৃতি হলেও, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের মতো নিরীহ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এই প্রেক্ষাপটে ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে পরিবেশ রক্ষায় গভীর দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দিয়েছে।

কোরআন, হাদিস ও বিদগ্ধ আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেয় যে—আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতি সংরক্ষণ করা প্রতিটি মুসলিমের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব।পরিবেশ রক্ষায় কোরআনের শিক্ষা

আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন,

وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا

‘পৃথিবীতে সংশোধনের পর সেখানে ফিতনা সৃষ্টি করো না।’ (সুরা, আরাফ, আয়াত ৫৬)  এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে পৃথিবীতে অশান্তি, ধ্বংস ও দূষণ সৃষ্টিকে নিষিদ্ধ করেছেন। আধুনিক ভাষায় যা পরিবেশ ধ্বংস, বন উজাড়, পানির অপচয় ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত।

ইসলাম মানবজাতিকে পৃথিবীর খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে পরিচয় দিয়েছে-

هُوَ أَنشَأَكُم مِّنَ الْأَرْضِ وَاسْتَعْمَرَكُمْ فِيهَا

‘তিনি তোমাদেরকে পৃথিবী থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে তা আবাদ করার দায়িত্ব দিয়েছেন।’ (সুরা হুদ, আয়াত ৬১) এখানেও স্পষ্ট যে পৃথিবীকে ধ্বংস নয় বরং সংরক্ষণ ও উন্নত করা মানবজাতির দায়িত্ব।

হাদিসে পরিবেশ রক্ষার শিক্ষা

রাসুলুল্লাহ (সা.) পরিবেশ রক্ষার জন্য নানান প্রেক্ষিতে বহুমাত্রিক শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন:

جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، يَقُولُ دَخَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى أُمِّ مَعْبَدٍ حَائِطًا فَقَالَ ‏”‏ يَا أُمَّ مَعْبَدٍ مَنْ غَرَسَ هَذَا النَّخْلَ أَمُسْلِمٌ أَمْ كَافِرٌ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَتْ بَلْ مُسْلِمٌ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ فَلاَ يَغْرِسُ الْمُسْلِمُ غَرْسًا فَيَأْكُلَ مِنْهُ إِنْسَانٌ وَلاَ دَابَّةٌ وَلاَ طَيْرٌ إِلاَّ كَانَ لَهُ صَدَقَةً إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‏”‏ ‏.‏

‘জাবির ইবনু আবদুল্লাহ্ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা উম্মু মাবাদ এর বাগানে ঢুকলেন।

তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মু মাবাদ! এ গাছ কে লাগিয়েছে? কোনো মুসলিম ব্যক্তি না কোনো কাফির? সে জানাল, মুসলিম। তিনি বললেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো গাছ লাগায়, আর তা থেকে মানুষ কিংবা চতুষ্পদ জন্তু অথবা পাখী খেয়ে নেয়, তবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তা তার জন্যে সাদাকা হিসেবে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৫২) বৃক্ষরোপণের এই শিক্ষা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর একটি পদক্ষেপ। 

অন্য এক হাদিসে এসেছে:

إِذَا قَامَتِ السَّاعَةُ وَفِي يَدِ أَحَدِكُم فَسِيلَةٌ، فَإِنِ اسْتَطَاعَ أَنْ لَا تَقُومَ حَتَّى يَغْرِسَهَا فَلْيَفْعَلْ

‘কিয়ামত এসে গেলেও যদি কারো হাতে একটি চারা থাকে এবং রোপণ করার সুযোগ থাকে, তবে সে যেন তা রোপণ করে।’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস:  ১২৯০২) এ থেকে বোঝা যায় যে গাছ লাগানো কেবল সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং আখিরাতের প্রস্তুতির অংশ।

পানি অপচয় প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ مَرَّ بِسَعْدٍ وَهُوَ يَتَوَضَّأُ فَقَالَ ‏”‏ مَا هَذَا السَّرَفُ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ أَفِي الْوُضُوءِ إِسْرَافٌ قَالَ ‏”‏ نَعَمْ وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهَرٍ جَارٍ ‏”‏ ‏.‏

‘আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ (রা.)-কে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি অজু করছিলেন। তিনি বলেন: এই অপচয় কেন? সাদ(রা.) বলেন, অজুতেও কি অপচয় আছে? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ যদিও তুমি প্রবহমান নদীতে থাকো।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২৫) বর্তমান বিশ্বে যেখানে পানির সংকট ভয়াবহ, সেখানে এ শিক্ষা কতোটা প্রাসঙ্গিক তা কেবল এর ভোক্তভোগীরাই বুঝবে।

মুসলিম স্কলারদের দৃষ্টিভঙ্গি

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন—‘আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তা মানুষের জন্য আমানত। এগুলোর ব্যবহার হবে ন্যায়সঙ্গত, অপচয় ও ধ্বংস নয়।’

আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ইউসুফ আল-কারজাভি তার Fiqh al-Bi’ah fi Dau al-Qur’an wal-Sunnah গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পরিবেশ ধ্বংস করা এক ধরনের “হারাম কাজ”, যা সমাজে ফিতনা সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সংকটে মুসলিম দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে এবং নবী (সা.)-এর নির্দেশিত “ইখলাস ও আমানতদারির” শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ ও আমাদের দায়িত্ব

বাংলাদেশে প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও খরার প্রভাব মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। নদী দূষণ, বন উজাড়, প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন সমস্যাকে তীব্র করছে। অথচ ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়— গাছ লাগানোকে সদকাহ মনে করা। পানির অপচয় রোধ করা। প্রাণীকুল ও প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেওয়া। পৃথিবীতে ফাসাদ বা দূষণ ও ধ্বংস সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা মুসলিমের অপরিহার্য কর্তব্য।

একজন সচেতন মুসলিম নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত ঘরে-বাইরে বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সাশ্রয় করা, বন উজাড় প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একক জাতি বা দেশের সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক সংকট। কিন্তু ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি মানুষের কাছে জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দিয়েছে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে পরিবেশ রক্ষা কেবল সামাজিক কর্তব্য নয়, বরং তা আল্লাহর ইবাদতের অংশ। তাই মুসলিম হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সচেতন হওয়া, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।


Scroll to Top