

‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক ইশতেহারের ভিত্তিতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। তিনি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। যদিও ওই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক আছে। বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামো, প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতি তাঁকে স্বৈরাচারে পরিণত করে। ক্ষমতায় এসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস, আরও কিছু চরম নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণভাবে করায়ত্ত করার মাধ্যমে গত ১৫ বছরের শাসনকালে শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হন। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। প্রথমে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
এ ছয় কমিশনের তৈরি সুপারিশগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। কিছু সুপারিশের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো দ্বিমত নেই এবং এগুলো অধ্যাদেশ হিসেবে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে কমিশনগুলো অধ্যাদেশের খসড়াও তৈরি করে দিয়েছে। সরকার এখন এগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে।
অন্য কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা; এক ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হবেন; একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান না হওয়া; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; রাষ্ট্রপতি নিয়োগ; সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ; দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন; সংবিধান সংশোধন—এসব সুদূরপ্রসারী সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। অতি গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং তাদের সম্মতি অর্জনের লক্ষ্যে প্রথম ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়, যার প্রধান অধ্যাপক ইউনূস নিজে।
৩৩টি রাজনৈতিক দল এবং জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা গতকাল শেষ হয়েছে। সৌহার্দ্যপূর্ণ এই আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো কোন কোন সুপারিশের ব্যাপারে একমত, দ্বিমত এবং আংশিকভাবে একমত, তা জানা যায়। একই সঙ্গে জানা যায় তাদের দ্বিমতের কারণ। আনন্দের বিষয় হলো, এসব আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু দল প্রস্তাবিত সুপারিশের পক্ষে তাদের মত তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করে এবং অন্য কিছু দল প্রস্তাবিত সুপারিশ সম্পর্কে তাদের দলীয় ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বলে কমিশনকে আশ্বস্ত করে।
রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের মধ্যে প্রথম দফার আলোচনার মাধ্যমে অধিকাংশ দলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। যেমন অধিকাংশ দলই সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, এক ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হবেন, দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান, সংসদে নারীর আসন সংখ্যা ১০০—ইত্যাদি বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কী প্রক্রিয়ায় তা অর্জিত হবে, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক দলগুলো ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হবে কি না, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। দ্বিমত রয়েছে কী প্রক্রিয়ায় নারীদের জন্য ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হবে তা নিয়ে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার আলোচনা এ মাসের মধ্যেই শুরু হবে। সেখানে নীতিগতভাবে একমত হওয়া বিষয়গুলোতে বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আশা করি। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতেই একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে বলেও আমরা আশাবাদী। সেই সনদ কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করবে। দ্বিতীয় ধাপে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আলোচ্য সুপারিশগুলো সম্পর্কে নাগরিক সমাজেরও মতামত নেওয়া হবে।
বদিউল আলম মজুমদার
সদস্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন