

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন চাকসুর হল সংসদ নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে ইসলামী ছাত্রশিবির ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মধ্যে। ছাত্রদের ৯ হলের ৭টিতে ছাত্রশিবির পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে। ছাত্রদলও একে একে হলে নিজেদের প্রার্থী তালিকা সাজাচ্ছে। বামধারার সংগঠনগুলো কোনো হলে প্যানেল দাঁড় করাতে পারছে না। ফলে হলভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবিটা ক্রমেই দুই সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলা-হামলার মুখে ক্যাম্পাসে ঠিকমতো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয় ২০২৩ সালের আগস্টে। কমিটিতে পাঁচজন সদস্য আছেন। রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার পর ছাত্রদল নিয়মিত ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশের আয়োজন করছে। তবে হলগুলোতে ছাত্রদলের কোনো কমিটি নেই।
অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে ২০১৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি ছাত্রশিবির। পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার পর তারা নানা কর্মসূচি পালন করেছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি ছাত্র হলেই সংগঠনটির কমিটি রয়েছে।
জানতে চাইলে ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আলী সত্যের পথকে বলেন, শুধু অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হল ও মাস্টারদা সূর্য সেন হলে তাঁরা প্যানেল দেননি। বাকি হলগুলোতে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা। পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়া হয়েছে।
আগামী ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
চাকসুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইতিমধ্যে ১১টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। আর হল সংসদে লড়তে ছাত্রশিবিরই প্যানেল ঘোষণা করেছে। ১৪টি হলে (ছাত্রীদের ৫টি) নির্বাচন করতে ৪৮১টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। এর মধ্যে ছাত্র হলে ৩৫৬ জন ও ছাত্রী হলে ১২৫ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। প্রতিটি হলে ভিপি ও জিএসসহ ১৪টি করে পদ রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলে প্যানেল দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের। বাকিদের সব হলে প্যানেল দেওয়ার অবস্থা নেই। ফলে হল সংসদ নির্বাচনে মূল লড়াই হবে এ দুই সংগঠনের প্রার্থীদের মধ্যে। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপরও নজর থাকবে ভোটারদের।
অন্যদিকে ছাত্রীদের প্রীতিলতা হলে প্যানেল ঘোষণা করেছে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা। নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে প্যানেল দিয়েছেন পাহাড়ি ছাত্রীরা। তাঁদের প্যানেলের নাম ‘হৃদ্যতার বন্ধন’। বাকি তিন হলে এখনো কেউ প্যানেল ঘোষণা করেনি।
ছাত্রদল এখনো ভাবছে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির ‘চাবি’ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হাতে ছিল। সংগঠনটি দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাত। একটি পক্ষের নেতা-কর্মীরা সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী, আরেকটি পক্ষের নেতা-কর্মীরা সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। এ দুই পক্ষই হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে হলে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারেননি। ছাত্রদল বলছে, কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারার কারণে হলে তারা কমিটিও দিতে পারেনি।
হলে প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন সত্যের পথকে বলেন, এক-দুই দিনের মধ্যে হলগুলোতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তাঁরা ঘোষণা করবেন। এখন অভ্যন্তরীণ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান জানান, হল সংসদে নির্বাচন করার জন্য একাধিক নেতা-কর্মী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কাকে কোন পদে রাখা হবে, এসব নিয়ে এখনো ভাবছেন তাঁরা। আর কেন্দ্রীয় সংসদে লড়তে ইতিমধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে।
বাম সংগঠনগুলোর দুর্বলতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে বামধারার ছাত্রসংগঠনগুলো দুই ভাগে বিভক্ত। এর একটি ভাগে রয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও জনসংহতি সমিতি-সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)। আরেক ভাগে রয়েছে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)।
কেন্দ্রীয় সংসদে লড়তে ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট প্যানেল ঘোষণা করেছে। তাদের প্যানেলের নাম ‘দ্রোহ পর্ষদ’। অন্যদিকে বাকি বামধারার সংগঠনগুলো ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ নামের প্যানেল দিয়েছে। তবে কোনো বাম সংগঠনই হলে প্যানেল দিতে পারছে না। তারা বলছে, ছাত্রলীগের দাপটের কারণে তারাও হলে তেমন কার্যক্রম চালাতে পারেনি। এখনো তাদের সামনে নানা ধরনের বাধা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা তারা করে চলেছে। সীমিত সামর্থ্য নিয়েই গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে হল সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে পারছেন না কেউ।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটি হয়েছিল ২০২২ সালে। ওই কমিটিতে মাত্র ৭ জন সদস্য আছেন। কমিটিতে পদ রয়েছে ১৪টি। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ঋজু লক্ষ্মী চাকসুতে ‘দ্রোহ পর্ষদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করছেন। তিনি সত্যের পথকে বলেন, বাম সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই হলে প্যানেল দিতে পারছে না। নিয়মিত নির্বাচনের আয়োজন হলে ভবিষ্যতে হলেও প্যানেল দেওয়া হবে।
ভিপি-জিএস হয়েছিলেন বাম নেতারা
সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয়েছিল ৩৫ বছর আগে, ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই নির্বাচনে জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ। তিনি পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৯৬৩ ভোট। পাশাপাশি শাহ আমানত হল থেকে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা জয়জীত কুমার বড়ুয়া। আলাওল হলের জিএস হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ইলিয়াস কবীর। শামসুন্নাহার হলে ভিপি হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রুবিনা মাহফুজ। অবশ্য সে সময় বাম সংগঠনগুলো, ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ ১২টি সংগঠন জোট বেঁধে নির্বাচন করেছিল। অপর প্রান্তে ছিল ছাত্রশিবির।
চাকসুর সর্বশেষ জিএস আজিম উদ্দিন আহমদ সত্যের পথকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর দাপট দেখা গেছে। বাম সংগঠন হলে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ তেমন একটা পায়নি। এই কারণে হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ছাড়া হলে হলে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে বাম সংগঠনগুলোর প্রভাব বাড়বে।
শেয়ার করুন:
- Click to share on Facebook (Opens in new window) Facebook
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window) WhatsApp
- Click to share on Telegram (Opens in new window) Telegram
- Click to email a link to a friend (Opens in new window) Email
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window) LinkedIn
- Click to share on Threads (Opens in new window) Threads