
পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল অনুযায়ী রক্ষাকবচের দাবিতে ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল লাদাখ উত্তাল হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেআন্দোলরত পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনাম ওয়াংচুককে শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে দেশটির পুলিশ। নেপালের মতোই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণরা। অনেক গণমাধ্যম তাই একে জেন জি আন্দোলন বলেও আখ্যা দিচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, লাদাখের এই আন্দোলন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যে, লাদাখের বেশ কিছু এলাকায় কারফিউ জারি রয়েছে এবং রাজধানী লেহ শহরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার তরুণদের বিক্ষোভ-আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। এই ঘটনায় মৃত্যু হয় চার জনের, আহত হন অর্ধশতাধিক, যাদের একটা বড় অংশ পুলিশ-কর্মী।
যুব-সমাজের এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘লাদাখ অ্যাপেক্স বডি’ এবং ‘কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ নামে দুটি সংগঠন। তবে আন্দোলনের মুখ হিসাবে ছিলেন ‘থ্রি ইডিয়েটস’ ছবির সূত্রে বহুল পরিচিত পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনাম ওয়াংচুক।
কারগিল মুসলমান প্রধান অঞ্চল, আর লাদাখে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদার দাবির পাশাপাশি যে ষষ্ঠ তফশিল অনুযায়ী রক্ষাকবচের দাবি জানাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা, ওই তফশিল অনুযায়ী আদিবাসীদের অধিকার, তাদের পরিচয় এবং তাদের উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা হয়।
লাদাখ অ্যাপেক্স বডি গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের দাবি নিয়ে অনশন আন্দোলন শুরু করেছিল। সোনাম ওয়াংচুকও ওই অনশনে যোগ দিয়েছিলেন। তবে বুধবারের সহিংসতার পরে মি. ওয়াংচুক বিবিসিকে জানান যে অনশন প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
শুক্রবার গ্রেফতার হওয়ার আগে বিবিসিকে দীর্ঘ সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন সোনাম ওয়াংচুক। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে বড় সংখ্যায় যুবক-যুবতীরা অংশ নিচ্ছেন। যুব-সমাজের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল। তাদের মনে হচ্ছিল যে এতজন মানুষ এতদিন ধরে অনশন করছেন, কিন্তু সরকার ছয়ই অক্টোবর আলোচনার তারিখ দিচ্ছে। এটাই তাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। কিন্তু পুলিশের কিছুটা ধৈর্য ধরা উচিত ছিল। তারা শরীরের এমন জায়গা লক্ষ্য করে গুলি না চালাতে পারত যাতে প্রাণ চলে যায়। গোড়ার দিকে পুলিশের কোনও ভুল ছিল না, কিন্তু পরে নিরস্ত্র মানুষের ওপরে গুলি চালায় পুলিশ।’
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য ওয়াংচুককেই এই সহিংসতার জন্য দায়ী করেছে। তারা বলছে, তার উসকানিমূলক ভাষণের জন্যই জনতা ক্ষেপে গিয়ে সহিংসতা শুরু করে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, সহিংসতা শুরু হওয়ার পরেই অনশন আন্দোলন শেষ করে দিয়ে ওয়াংচুক অ্যাম্বুলেন্সে চেপে নিজের গ্রামে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি কোনও চেষ্টাই করেন নি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় কম্যান্ডের প্রাক্তন কম্যান্ডার-ইন-চিফ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল দীপেন্দ্র হুডা বলছিলেন যে লাদাখের মানুষের দাবিগুলো খুবই সংবেদনশীল হয়ে শোনা উচিত।
তার কথায়, ‘লাদাখকে যখন কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করা হল, তখন সেখানকার মানুষ বিষয়টাকে খুবই ইতিবাচক-ভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মনে হতে থাকে যে তাদের অধিকার সুরক্ষিত হচ্ছে না। তাদের কাজের সুযোগ বাইরের মানুষ নিয়ে নিচ্ছেন, সংস্কৃতির ওপরে আঘাত আসছে। আমার মনে হয় লাদাখের মানুষের দাবিগুলো ভুল নয়, কিন্তু দাবি আদায়ের পথ তো সহিংস হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘লাদাখ ভারতের কাছে কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ চীন আর পাকিস্তান – দুই দেশেরই সীমানা জুড়ে আছে লাদাখের সঙ্গে। চীনের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তে গত কয়েক বছর ধরেই উত্তেজনা চলছে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা তো আছেই। ভারতের নিরাপত্তার জন্য লাদাখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, লাদাখের আন্দোলন যদি সরকার ঠিকমতো সামলাতে না পারে তাহলে তার প্রভাব কাশ্মীরেও পড়বে, সেখানকার যুব-সমাজও লাদাখের আন্দোলনের দিকে নজর রাখছে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মোদি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
জম্মু-কাশ্মীরের ঘটনাবলীর ওপরে নজর রাখেন ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক রাহুল পণ্ডিতা। তিনি বলেন, লাদাখ নিয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত, এই বিক্ষোভ যাতে হাতের বাইরে চলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।