রাজনীতিতে থালাপতির উত্থান, তামিল সিনেমার প্রভাব।

টিভিকের সভাপতি ও অভিনেতা থালাপতি বিজয়। ইলাস্ট্রেশন: সত্যের পথে

জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর ওরফে থালাপতি বিজয়। ভারতের তামিলনাড়ুতে সিনেমার নায়ক থেকে রাজনীতিবিদ হওয়ার সবশেষ উদাহরণ।

রাজ্যটিতে আগেও কয়েকজন রূপালি পর্দা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছেন। তবে বাকিদের তুলনায় থালাপতি বিজয়ের রাজনৈতিক যাত্রায় সিনেমার গল্পের মতো নাটকীয়তা যোগ করেছে গতকাল শনিবারের অনাকাঙ্খিত এক ঘটনা।

আইএমডিবির তথ্য অনুযায়ী, বিজয় থালাপতির সবশেষ সিনেমা ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অলটাইম’ মুক্তি পায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এর প্রায় চার বছর আগে ২০১৮ সালে মুক্তি পায় তার সিনেমা ‘সরকার’, যেখানে এক ব্যবসায়ীর রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর নির্বাচনে জিতেও যান। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দল ‘তামিলাগা ভেট্রি কাজগাম (টিভিকে)’ গঠনের পর বিজয়ের রাজনীতির যাত্রাকে দেখা হচ্ছিল এই ‘সরকার’ সিনেমার গল্পের মতো করে। 

কিন্তু শনিবারের সমাবেশে পদদলিত হয়ে ৪০ জনের মৃত্যুর ঘটনা বিজয়ের রাজনৈতিক জীবনকে যেন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে। কিছুদিন আগেও বিজয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিনের সমালোচনা করেন। সেই স্টালিনই এখন শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন করে আলোচনায়। এম কে স্টালিনও এক সময় রূপালি পর্দার অভিনেতা ছিলেন।

বিজয়ের আলোচনায় আসা
বাণিজ্যিক সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রের আবির্ভাব (দৃশ্যে) নিয়ে বেশ মাথা খাটাতে হয় পরিচালকদের। বিজয়ের বড় পরিসরে রাজনীতিতে পা রাখার মুহূর্তটাও অনেকটা সেভাবে সাজানো।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দল গঠনের খবর দিলেও এরপর অনেকটা নীরব ছিলেন বিজয়। মূলত তিনি ও তাঁর দলের সদস্যরা একটি মুহূর্ত খুঁজছিলেন, যেখানে সহজেই জনসাধারণের সাড়া পাওয়া যাবে।

এই মুহূর্তটি আসে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই মাসের ৫ তারিখে মুক্তি পায় বিজয়ের ‘গ্রেটেস্ট অব অলটাইম’ সিনেমা। আর ২৫ সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর কেন্দ্রস্থল ত্রিচিতে হয় সমাবেশ। মূলত, সিনেমা মুক্তির পরপরই ওই সমাবেশের সময় নির্ধারণ করা হয়, যাতে চলচ্চিত্র নিয়ে উন্মাদনার মধ্যেই বিজয়ের রাজনীতে উপস্থিতির বিষয়টি আলোচনায় থাকে।

বনের রাজা সিংহ
থালাপতি বিজয় রাজনীতিবিদ হিসেবে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের নজর কাড়েন চলতি বছরের আগস্টে। তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরে এক মহাসমাবেশে তিনি ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশাসনকে অ্যাখ্যা দেন ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে, যে খবর বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পায়।

২০১৫ সালে ‘দুই পৃথিবী’ নামের একটি সিনেমায় বাংলাদেশি সুপারস্টার শাকিব খানের একটি সংলাপ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে শাকিব খানকে বলতে শোনা যায়, ‘সুন্দরবনে শুধু বাঘই থাকে না, সিংহও থাকে’।

গত আগস্টের মহাসমাবেশে থালাপতি বিজয়ের ভাষণেও উঠে আসে এমন সংলাপ। বিজেপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘জঙ্গলে অনেক শিয়াল থাকে, কিন্তু সিংহ থাকে মাত্র একটি। সিংহ জানে কি করে টিকে থাকতে হয়।’

শনিবারের পদদলন
আগামী বছর তামিলনাড়ুতে হতে যাচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। মূলত এই নির্বাচন ঘিরেই প্রচার চালাচ্ছিলেন বিজয়। শনিবার সমাবেশটি হয় তামিলনাড়ুর কারুরে।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ কর্মকর্তা ও থালাপতি বিজয়ের ঘনিষ্ঠজনের বরাত দিয়ে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, পদদলনের ঘটনা ঘটে ভাষণ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর। সবকিছু ঘটে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে। গাছে ওঠা কয়েকজন ভক্ত ডাল ভেঙে নিচে ভিড়ের মধ্যে পড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়।

কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, লোকজন বিজয়কে একনজর দেখার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করেন। ওই সময় কয়েকজন অচেতন হয়ে পড়েন। গরম ও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে লোকজন হাঁপিয়ে ওঠেন। বিজয় তখন ভাষণ থামিয়ে ভিড়ের দিকে পানির বোতল ছোঁড়েন। এরপর আবারও ভাষণ শুরু করেন। এর মধ্যেই পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর, সমাবেশস্থলে প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়ো হওয়ার জায়গা ছিল। কিন্তু সেখানে ভিড় করেছিলেন প্রায় ২৭ হাজার মানুষ। বিকেলে সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিজয় থালাপতি পৌঁছান সন্ধ্যার দিকে। এতে লোকসমাগম বেড়ে যায়।

বিজয়ের কী হবে
হিন্দুস্থান টাইমসের খবর অনুযায়ী, সমাবেশে হতাহতের পর সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) রোববার ট্রেন্ডিংয়ে ছিল ‘অ্যারেস্ট বিজয়’ হ্যাশট্যাগ। গত আগস্টে বিজেপিকে হুঙ্কার দিয়ে যে বিজয় টিকে থাকার প্রত্যয় করেছিলেন, তাঁর জন্য কাজটি এখন কিছুটা কঠিনই হলো।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, কারুরের ঘটনার পর অনেকেই এখন ক্ষিপ্ত। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এমন ঘটনা ও মৃত্যুর খবর জানার পরও বিজয় ঘটনাস্থল থেকে চুপচাপ চলে গেছেন। ঘটনার পর কারুরে শোকাহত পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন। তখন সাংবাদিকরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, বিজয়কে কি গ্রেপ্তার করা হবে? জবাবে স্টালিন বলেন, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নের উত্তর দেবেন না।

তামিলনাড়ুর মূখ্যমন্ত্রী ও সাবেক অভিনেতা এম কে স্টালিন। ছবি: সংগৃহীত

তবে প্রশাসনের তৎপরতা থেমে নেই। পদদলনের ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, সরকার বিজয়কে গ্রেপ্তারের বিকল্প বিবেচনা করেনি। তবে মুখ্যমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এর প্রভাব নিয়ে শতবার ভাববেন। কারণ, গ্রেপ্তার হলে বিজয়ের জনসমর্থন আরও বাড়তে পারে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওইদিন আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও পদক্ষেপ নিতে পারেন।

ষড়যন্ত্রের গন্ধ
এনডিটিভির খবর, পদদলনের ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছে বিজয়ের দল টিভিকে। আর এই অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী ও সাবেক অভিনেতা এম কে স্টালিনের দল ডিএমকে-এর বিরুদ্ধে। টিভিকের আইনজীবী রোববার মাদ্রাজ হাইকোর্টে অধিকতর তদন্তের জন্য একটি আবেদনও জমা দিয়েছেন। তারা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে দিয়ে তদন্তের অনুরোধ করেছেন।

তবে ডিএমকের মুখপাত্র সৈয়দ হাফিজুল্লাহ বলেছেন, তারা এ ঘটনার রাজনীতিকরণ চান না। আইন তার নিজস্ব পথে চলুক।

সাধারণ মানুষের কাছে ৪০ জনের মৃত্যুর ঘটনা অবশ্যই বেদনাদায়ক। কিন্তু রাজনীতিবিদদের কাছেও কি তাই? অনিল কাপুরের ‘নায়ক’ (২০০১) সিনেমায় আমরা দেখেছি, মহারাষ্ট্রের একজন মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে মানুষের দুর্ভোগকে ভোট ব্যাংক বানানোর হাতিয়ারে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। বাস্তবজগতেও এমন কৌশলের কানাঘুষা শোনা যায়। তামিলনাড়ুতে কি হবে তা সময়ই বলে দেবে।

Leave a Reply

Scroll to Top