ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের লাইন-৫ (এমআরটি-৫ দক্ষিণ লাইন)-এর নির্মাণকাজ অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে শুরু হচ্ছে না। সরকার ও ঋণদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)– কোনো পক্ষই বড় ব্যয়ের প্রকল্পটির বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমানোর প্রস্তাবও কোনো কাজে আসেনি। পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশন থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উঠছে না।
বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রকল্পটি আর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারাও একই ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ঢাকার গাবতলী থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল গত বছর। ২০২২ সালেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার জন্য ইতোমধ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনা শেষে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একনেকে প্রকল্পটির অনুমোদন আটকে যায়।
সূত্র জানায়, সড়ক বিভাগ থেকে কয়েক মাস আগে ডিপিপি পুনর্গঠন করে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়। সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। আরও কিছু পরিবর্তনও আনা হয় ডিপিপিতে। তবে রুট পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়নি। নতুন ডিপিপির ওপর মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়। এর পর অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগে পাঠানো হয় দুই মাস আগে। তবে সরকারের সায় না পাওয়ায় একনেকে না তুলে ফেলে রাখা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, পুনর্গঠিত ডিপিপি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে একনেক বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উত্থাপনের কথা। কেন একনেকে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না– জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
এমআরটি-৫ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের যৌথভাবে ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা। বাকি ১৫ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব। ২০২২ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করে প্রকল্পে প্রধান ঋণদাতা সংস্থা এডিবি ও কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে কাঠামো চুক্তি হয় চার বছর আগে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ।
ইআরডির এডিবি উইংয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা গত সোমবার সমকালকে বলেন, এডিবি আপাতত বড় অঙ্কের এই ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। তবে একেবারে নাকচও করেনি তারা। তিনি জানান, সরকারও এ মুহূর্তে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ সরকারের সময় প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেন, মেট্রোরেল মোটা অঙ্কের বিনিয়োগের প্রকল্প। কত বেশি যাত্রীকে সেবা দেওয়া যায়, সে বিবেচনা থেকে রুট পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। মেট্রো-৫ প্রকল্পটির আর্থসামাজিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা যাচাই করা দরকার। বাদ দেওয়ার বিষয়টি যাচাইয়ের নিরিখেই হওয়া উচিত।
রাজধানীর পূর্ব-পশ্চিম সংযোগকারী প্রকল্প হিসেবে মেট্রোরেল-৫ দক্ষিণ গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মোট ১৫টি স্টেশনের কথা বলা হয়। রুট পরিকল্পনায় ছিল গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজগেট, আসাদগেট, ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, আফতাবনগর, আফতাবনগর সেন্টার, আফতাবনগর পূর্ব, নাসিরাবাদ এবং দাশেরকান্দি। প্রকল্প প্রস্তাব গত মার্চে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়।
প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব সমকালকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা সরকারের নীতি সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে নগরবাসীর যোগাযোগ উন্নয়ন এবং ট্রাফিক জ্যাম থেকে মুক্তির জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি রুট ছিল। প্রকল্পটির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাদ দেওয়া হলে জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। আবার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় জলে যাবে। ঋণের সুদ টানতে হবে। পরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। প্রকল্পের কাজ শুরু করার মতো সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। প্রকল্পের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি বলেন, রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণকেন্দ্রিক একাধিক সড়ক অবকাঠামো আছে। তবে পূর্ব-পশ্চিমকেন্দ্রিক যোগাযোগ অবকাঠামো কম। রাজধানীর যোগাযোগ কাঠামোতে ভারসাম্য আনার লক্ষ্যেই মেট্রো-৫ দক্ষিণ প্রকল্পটির নকশা উন্নয়ন করা হয়। কাজ অনেকদূর এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রস্তুত।
প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এই মেট্রোরেল ব্যবহার হলে বছরে মোট ২১ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। বছরে জ্বালানি সাশ্রয় হবে ৪১ দশমিক ২২ হাজার টন। রাস্তায় এক হাজার ৪৯টি গাড়ির চলাচল কমবে।