মাথা গোঁজার স্থান হারিয়ে, ধ্বংসস্তূপে পড়াশোনার সামগ্রী খুঁজছেন শিক্ষার্থীরা

দুই মিনিটের ঝড় সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঘরের টিন। আসবাব তছনছ। মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ঘরের ভেতর বই-খাতা খুঁজে বের করে রোদে শুকাতে দিয়েছে কলেজছাত্র লিটন মিয়া। সোমবার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় আলমবিদিতর ইউনিয়নের খামার মোহনা গ্রামে সত্যের পথে

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের খামার মোহনা এলাকায় এক শতক জমির ওপর একটি ঝুপড়ি ঘর পঞ্চাশোর্ধ্ব নজরুল ইসলামের। স্ত্রী মারা গেছেন সাত বছর আগে। ছেলে ও ছেলের বউ ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করেন। ১০ বছরের নাতি তামিমকে নিয়ে তাঁর সংসার। রোববার হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ঘর উড়ে যায়।
শুধু নজরুল ইসলামের নয়; ঝড়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আলমবিদিতরের খামার মোহনা, কুতুব ও কিশামত গণেশ এলাকায় ৪০০ ঘরবাড়ি ও নোহালী ইউনিয়নের সরদারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ৩০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ের তাণ্ডবে টিনশেড ও আধা-পাকা ঘরবাড়ি, গাছপালা ভেঙে পড়ে। এতে পাঁচজন আহত হয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তিন দিন ধরে খোলা জায়গায় অবস্থান করলেও মেলেনি সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য। নেই খাবার, সেই সঙ্গে মাথা গোঁজার ঠাঁইও।
খামার মোহনা এলাকায় দেখা যায়, ঝড়ে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে গ্রামটি। বাড়িঘর ও গাছপালা মিশে গেছে মাটিতে। আধাপাকা বাড়ির টিনের চালও উড়িয়ে নিয়ে গেছে এক কিলোমিটার দূরে। বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘর দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। খোলা জায়গায় রান্নার প্রস্তুতি চলছিল বেশ কয়েকটি পরিবারের। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ধ্বংসস্তূপের ভেতরে খুঁজছিল বই-খাতা, ব্যাগসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ। ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে রান্নার পরিবেশ না থাকায় না খেয়ে আছেন অনেকেই।

নজরুল ইসলামের ঘরের সামনে গেলে দেখা যায়, তিনি নাতি তামিমের ভিজে যাওয়া বই-খাতা শুকাচ্ছিলেন। তাকে নানা তহুবর রহমান এসে নিয়ে গেছেন। আক্ষেপ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নাতিটাক নিয়েই এই ঘরটাতে থাকোং। সেই ঘরোতও আর থাকা যায় না। আইজ না হউক, কাইল ঘর ভালো হইবে। তয় নাতিটার বইগুলা নষ্ট হইলে কোনটে পাইম!’
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত রফিকুল ইসলাম বলেন, দুই মিনিটের ঝড় সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। ঘরের টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। কিছু অবশিষ্ট নেই। পরিবার নিয়ে উপোস করছি।
আমিনুর রহমান বলেন, এখনও সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি। দূর গ্রাম থেকে খালা ভাত নিয়ে এসেছিলেন। তাই খেয়ে দিন কাটছে। বেশির ভাগ পরিবারে তাদের আত্মীয়স্বজন খাবার নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছেন।
খামারে ৮০০ মুরগি ছিল আইনুর রহমানের। ঝড়ে বাড়ির সবকটি ঘরের সঙ্গে খামারও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মুরগিগুলো মারা গেছে। খালি ভিটায় বসে বিলাপ করছিলেন তিনি। মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ঘরের ভেতর বই-খাতা খুঁজছিলেন তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলে লিটন মিয়া।

আনোয়ারমারী ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী লিটন বলেন, সব বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এই ক্ষতি পূরণ হবে না। পাশেই বসে কাঁদছিল আশরাফুল আলমের মেয়ে কচুয়া আহমদিয়া মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়শা খাতুন। সে বলে, ‘অভাবের সংসারে কষ্ট করে পড়াশোনা করি। ঝড়ে ঘর পড়ে যাওয়ায় সব বই-খাতা ভিজে গেছে। এসব আর কে কিনে দেবে!’
উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আফতাবুজ্জামান চয়ন বলেন, আকস্মিক ঝড়ে দুই ইউনিয়নের সাত শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে খেটে খাওয়া পরিবারগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আট টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শুকনো খাবারসহ চাল বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাড়িঘর সংস্কারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Scroll to Top