প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও রোগী বাড়লেও মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে তেমন গতি নেই। নানা কারণে এ বছর দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর জনপ্রতিনিধিদের একযোগে বরখাস্ত করা হলে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় শূন্যতা তৈরি হয়। আগে মশককর্মীর কার্যক্রম সুপারভাইজারের মাধ্যমে সরাসরি তদারকি করতেন কাউন্সিলররা। এখন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর না থাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এক রকম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মশককর্মীর কার্যক্রম তদারকির জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সহযোগিতা নিলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) তাও করেনি। ডিএনসিসি জলাশয়গুলোতে নোভালরুন ট্যাবলেট ছিটালেও ডিএসসিসি এদিক থেকে পিছিয়ে। জলাশয়গুলোর কচুরিপানা ও আবর্জনা পরিষ্কারেও এবার গতি কম।
তার ওপর মাঝেমধ্যে ভারী বৃষ্টি হওয়া মশার বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল, এবার তাই-ই হয়েছে। একবারের বৃষ্টিতে মশার বংশবিস্তারের অসংখ্য ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বর্ষা মৌসুমের আগে উন্মুক্ত ড্রেন, বক্স-কালভার্টের বর্জ্য যেভাবে অপসারণের প্রয়োজন ছিল, সেখানেও এবার ঘাটতি ছিল। ফলে ওই সব স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় মশা বংশবিস্তারে আরও সুযোগ পেয়েছে।
এদিকে মশক নিধনের জন্য কিছু হুইলব্যারো মেশিন সংগ্রহ করা হলেও সেগুলো পরীক্ষাই করতে পারেনি ডিএনসিসি। আজ সোমবার পরীক্ষার কথা থাকলেও পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি না থাকায় সেটি আর হচ্ছে না। সব মিলিয়ে এবার মশক নিধন কার্যক্রম একেবারেই লেজেগোবরে।
নগরবাসীর অভিযোগ, এখন ১০ থেকে ১২টি ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তারা ওয়ার্ডের অলিগলিও চেনেন না। ফলে কোন এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে, সেটি বুঝতে পারছেন না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মশক কার্যক্রমে গতি আনতে সারাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামো যত দ্রুত সম্ভব চালু করা উচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এডিস মশার বিষয়ে নগরবাসীকে সচেতন করতে মেয়রসহ স্থানীয় কাউন্সিলররা মাঝেমাঝেই বের করতেন শোভাযাত্রা। উপাসনালয়ে ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করে তাদের দিয়েই করা হতো আঙিনা পরিষ্কার। পাড়া-মহল্লায় লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করেও জনসচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চলত।
ড্রোন দিয়ে ওপর থেকে মশার ক্লাস্টার চিহ্নিত করে সেখানে ওষুধ ছিটানোর কাজও চলেছে কখনও কখনও। ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্মাণাধীন ভবন বা স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা, মশা বা মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ পেলেই করেছেন জরিমানা। গুণী ও জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে চলেছে ডেঙ্গুবিষয়ক নানা প্রচারাভিযান।
এমনকি ডাবের খোসা, ফুলের টব, ভাঙাচোরা কমোডের মতো মশার বংশবিস্তার উপযোগী পাত্র কেনার জন্য গত বছর ডিএনসিসি বিজ্ঞপ্তিও দেয়। যদিও তাতে খুব একটা সাড়া মেলেনি। তবে মানুষের মধ্যে আলোচনা তৈরি হওয়ায় ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছিল। এবার এসবের ঘাটতি স্পষ্ট।
ডিএনসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (শেওড়াপাড়া-কাজীপাড়া-সেনপাড়া এলাকা) কার্যালয়ের সহকারী ওয়ার্ড সচিব কাউছার আলী বলেন, এখন ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি হয় না। ওষুধও দেওয়া হয় না। সবকিছু আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১০টি করে ২০টি অঞ্চলে ২০ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও আছেন ১১ জন। আগে মশককর্মীদের ওষুধ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন প্রতিটি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর। দুই সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর ছিলেন ১২৬ জন।
ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় ওয়ার্ড সচিব জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হতো। সে সময় মানুষ ভয় পেয়ে কথা শুনত। এখন সুপারভাইজারের কথা এলাকাবাসী শুনতে চায় না। তবে কিছুদিন হলো বিএমটিএফের পক্ষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা মাঝেমধ্যে এসে মশককর্মীরা ঠিকমতো ওষুধ ছিটায় কিনা, দেখে যান।
এদিকে ডিএসসিসির মশক নিধনের লাইভ মনিটরিং গ্রুপে দেখা যায়, দুর্গাপূজার ছুটিতে ৭৫টি ওয়ার্ডের মশক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। শুধু ২২ নম্বর ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজার মাসুদ রানা সিটি কলোনি দুর্গামন্দিরের পাশে এডাল্টিসাইটিং করেছেন। শনিবার করপোরেশনের ফেসবুক গ্রুপের লাইভ মনিটরিংয়ে দেখা যায়, ১৪টি ওয়ার্ড এলাকায় লার্ভিসাইডিং করা হয়েছে। আর ১৩টি ওয়ার্ড এলাকায় বিকেলে এডাল্টিসাইটিং করা হয়েছে। গতকাল ৩২টি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং আর ২৮টি ওয়ার্ডে বিকেলে এডাল্টিসাইটিং করা হয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং করার জন্য সকালে সাত মশককর্মী আর বিকেলে ছয় মশককর্মী থাকার কথা। তবে প্রতিটি ফেসবুক লাইভে মশক সুপারভাইজারের সঙ্গে শুধু একজন স্প্রেম্যানকে দেখা গেছে।
ডিএসসিসির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজার সানাউল্লাহ অমিত বলেন, ‘আমরা সকালে যেখানে মশা জন্ম নিতে পারে, সেসব জায়গায় লার্ভিসাইডিং আর বিকেলে এডাল্টিসাইটিং করে থাকি। এ ছাড়া করপোরেশনের সরবরাহ করা লিফলেট বিতরণ করে তিন দিনের বেশি কোনো স্থানে পানি জমিয়ে না রাখাসহ আশপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে জনসচেতনতার কাজ করি।’
মশক বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার সমকালকে বলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে মশক প্রজননের হার বাড়ে। এই সময়টাতে পূজার বন্ধের কারণে মশক নিধন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে হঠাৎ মশার বংশবিস্তার ও সংক্রমণের হার বেড়েছে। মশক কার্যক্রমে গতি আনতে সারাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোকে দ্রুত চালু করা উচিত।’
এবার মশক নিধন কার্যক্রমে যে ভাটা, তা মানতে রাজি নয় ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী সমকালকে বলেন, জনপ্রতিনিধি না থাকায় বিএমটিএফকে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত সে কাজ করছে। শোভাযাত্রা করা হচ্ছে না, কারণ তাতে কাজের সময়টা নষ্ট হয়। তিনি বলেন, মশার ওষুধের ঘাটতি নেই।
মশককর্মীরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন। কারণ তাদের দিনে চারবার সুপারভাইজারের মোবাইলে থাকা অ্যাপস দিয়ে কাজের হাজিরা নিশ্চিত করতে হয়। জলাশয় পরিষ্কার করার পাশাপাশি সেখানে নোভালরুন ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে।
তথ্য-উপাত্ত দেখিয়ে তিনি বলেন, এবার ডিএনসিসি এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক কম। তবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ক্যান্টনমেন্ট, ডিওএইচএসের মতো জায়গায় মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে না পারায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। মশক নিধন কার্যক্রম একটি সমন্বিত বিষয়। দেখা যাচ্ছে, কিছু এলাকায় তারাও মশক নিধন করছে না, ডিএনসিসিকেও করতে দিচ্ছে না।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশাদ পারভীন সমকালকে বলেন, প্রতিদিন সকাল-বিকেলে প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করা হচ্ছে। আমরা এ বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর জনসচেতনতার কাজে জোর দিয়েছি। করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে ছোট ছোট টিম করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে। তবে কাউন্সিলররা থাকলে জনসচেতনতাসহ সার্বিক কাজটা সহজ হতো।