
টিমটিমিয়ে চলছে একসময়কার ব্যবসাসফল বলপয়েন্ট কলমের প্রস্তুতকারক কোম্পানি জিকিউ বলপেন। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির শেয়ারদর ছুটছে তেজি ঘোড়ার মতো। গেল তিন মাসেরও কম সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৭০ থেকে বেড়ে এখন ৫৯৬ টাকায় উঠেছে।
শেয়ারদরে এমন লাগামাহীন বৃদ্ধির নেপথ্যে যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই দর বৃদ্ধির নেপথ্যে আছে কারসাজি। একটি চক্র নিয়মিতভাবে শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে।
ভালো-মন্দ মিলে আরও শেয়ারের দর বাড়ছে
সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহের সামান্য পতন বাদ দিলে জুন থেকে শুরু করে চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ছিল শেয়ারবাজার। এর পর গত তিন সপ্তাহ ধরে ফের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। ফলে কমছে বেশির ভাগ শেয়ারের দর, সূচক এবং লেনদেন।
তবে এর মধ্যেও ভালো ও মন্দ মিলে ডজনখানেক কোম্পানির শেয়ারদর ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী আছে। এ ধারায় থাকা ইনফরমেশন সার্ভিসেসের শেয়ারদর দুই মাসেরও কম সময়ে ১৫৭ শতাংশ বেড়েছে। চার মাসে প্রগতি লাইফের দর বেড়েছে ১৭৪ শতাংশ। চার মাসে এশিয়াটিক ল্যাবের দর দ্বিগুণ হয়েছে। তিন মাসে দ্বিগুণ হয়েছে সালভো কেমিক্যালের দর। তিন মাসের কম সময়ে কেঅ্যান্ডকিউর ৮৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
দেড় মাসেরও কম সময়ে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট এবং শ্যামপুর সুগারের শেয়ারদর ৭০ শতাংশ বেড়েছে। গত চার মাসে সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ৭৩ শতাংশ, ফাইন ফুডসের ৪৫ শতাংশ এবং ফারইস্ট নিটিংয়ের ৩৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
সবার থেকে আলাদা জিকিউ
গত ৭ জুলাই জিকিউ বলপেন কোম্পানির শেয়ার ১৬৯ টাকায় কেনাবেচা হয়। গতকাল রোববার ৫৯৬ টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ গত তিন মাসেরও কম সময়ে সাড়ে তিন গুণে উন্নীত হয়েছে। শেয়ারদরে যতটা তেজি ভাব দেখা যাচ্ছে, ততটাই রুগ্ণ ধারা ফুটে উঠছে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে। গত বছরের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরে প্রতি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে শেয়ারের বিপরীতে জিকিউ বলপেন তিন টাকা ৩৮ পয়সা লোকসান করার তথ্য দিয়েছিল। ২০২৫ হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসেই লোকসান ছাড়িয়েছে তিন টাকা ১৬ পয়সা।
এ অবস্থার কারণ হলো– মূল ব্যবসা বলপয়েন্ট কলম প্রস্তুত ও বিক্রি নেই বললেই চলে। এক যুগের বেশি সময় ধরে কলম বিক্রির ব্যবসায় আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। ২০২৪ সালে জিকিউ বলপেনের পণ্য বিক্রি থেকে আয় ছিল পাঁচ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। অথচ এর পেছনে খরচ হয়েছিল সাত কোটি ৫৪ লাখ টাকা। গত ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসে দুই কোটি ৭৯ লাখ টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে মূল ব্যবসা থেকে আয় মাত্র দেড় কোটি টাকা।
শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মূল ব্যবসা থেকে মুনাফা করার উদ্দেশ্যে নয়, এ কোম্পানি চলছে শেয়ার ব্যবসা থেকে কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্যে। বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেয়ার ব্যবসা এবং এফডিআর থেকে সুদ আয় দিয়ে কোম্পানি কোনোভাবে টিকে আছে। এর মধ্যে উত্তরার জমি ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন করেছে, যার সাড়ে ৪৮ শতাংশ মালিকানা এ কোম্পানির। নতুন করে এর থেকে ভাড়া আয় কোম্পানির হিসাবে যোগ হবে। এসব বিষয়ে জানতে জিকিউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কুমার সাহাকে ফোন করা হলে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, এসব বিষয়ে ডিএসইকে জানানো হয়েছে।
গত জুলাইয়ের শুরুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ জিকিউ বলপেনের ব্যবসা বিষয়ে জানতে চায়। কোম্পানি সচিব কেএম এরশাদ উত্তরে জানান, কোম্পানি ২০২৩ সালে বিএমআরইর সিদ্ধান্ত নিলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ভারত ভিসা না দেওয়ায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরেজমিন দেখে ক্রয় আদেশ দিতে পারছে না। বিকল্প চীন বা জার্মান থেকে একই যন্ত্র আনতে অনেক খরচ পড়বে, যা দিয়ে ব্যবসায় উন্নতি করা সম্ভব হবে না। এ কারণে ভারতের ভিসার অপেক্ষায় আছে কোম্পানি।
কারখানা বিএমআরইর খরচের কিছু অংশ উত্তরা ভবনের ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে মেটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানান কোম্পানি সচিব। ডিএসইকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতি মন্থর হওয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন না। এ কারণে উত্তরা ভবনের ছয়টি তলার মধ্যে মাত্র একটি তলা ভাড়া দেওয়া গেছে। ভাড়া থেকে যথেষ্ট আয় না হওয়ায় বিএমআরই খরচ মেটানো যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ে কারখানা সংস্কার করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ও চুক্তিভিত্তিক বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা চালু রাখা হচ্ছে।