বাংলাদেশে পপ স্থাপনের পরিকল্পনায় স্টারলিংক


বাংলাদেশে নিজেদের পয়েন্ট অব প্রেজেন্স (পপ) স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবাদাতা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক। সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠিয়েছে তারা। বিষয়টিকে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি হিসেবে দেখছে বিটিআরসি। স্টারলিংকের প্রস্তাবটি যাচাই করে দেখার কথা জানিয়েছে তারা। তবে এক্ষেত্রে আগে নিজেদের সক্ষমতা বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

স্টারলিংকের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুর ও ওমানের পপের সঙ্গে আইপিএলসির মাধ্যমে যুক্ত হবে বাংলাদেশে স্থাপন করা পপ। প্রতিটি পপ কমপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক পপের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সংযোগের মাধ্যমে স্টারলিংক ‘আনফিল্টারড আইপি ট্রানজিট’ ব্যবহার করবে, যা কেবল আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ পরিবহন করবে- বাংলাদেশের স্থানীয় ট্রাফিক বা অভ্যন্তরীণ ইন্টারনেট কার্যক্রমের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। স্টারলিংক স্পষ্ট করেছে, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবহারকারী স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (ওওএ) মাধ্যমে রাউট হবে। ফলে দেশীয় নিরাপত্তা, আইনানুগ আড়িপাতা, কিংবা কনটেন্ট ব্লকিংয়ের বিধান অবিকল কার্যকর থাকবে।

স্টারলিংক আরও জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে আনফিল্টারড আইপি সেবা নেওয়ার জন্য অনুমোদিত দুটি প্রতিষ্ঠান- ফাইবারঅ্যাটহোম ও সামিট কমিউনিকেশনস-এর সঙ্গে কাজ করবে। এই দুই প্রতিষ্ঠানই দেশের ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) ও ওওএ লাইসেন্সধারী।

ব্যান্ডউইথ রপ্তানি, ট্রানজিট নয় : এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে ব্যান্ডউইথ রপ্তানির অংশ হিসেবেই দেখছি, ট্রানজিট নয়। বাংলাদেশ আগে থেকেই ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করে আসছে- যেমন ভারতের ত্রিপুরায় ব্যান্ডউইথ যাচ্ছে, যার সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্টারলিংক যদি ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করতে চায়, তা হলে তা সরকারের অনুমোদনের বিষয়। তার আগে আমরা প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো যাচাই করে দেখব। এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে।’

কৌশলগত সুযোগ : তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় স্টারলিংকের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ। বর্তমানে ভুটান স্টারলিংকের সেবা নিচ্ছে সিঙ্গাপুরের ব্যান্ডউইথের মাধ্যমে- যা দূরত্বের কারণে ব্যয়বহুল ও মানের দিক থেকে দুর্বল। তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভুটান ও নেপালের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক। সুতরাং স্টারলিংক যদি এই দেশগুলোতে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে চায়, তা হলে বাংলাদেশের ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ও লাভজনক বিকল্প হবে।

দেশে স্টারলিংকের চারটি গ্রাউন্ড স্টেশন : বর্তমানে বাংলাদেশে স্টারলিংকের চারটি গ্রাউন্ড স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি গাজীপুরে, একটি রাজশাহীতে এবং একটি যশোরে অবস্থিত। এসব স্টেশন মূলত স্যাটেলাইট ও স্থলভিত্তিক নেটওয়ার্কের মধ্যে ডেটা আদান-প্রদানের কাজ করে।

খাতসংশ্লিষ্টদের হিসাবে, দেশে বর্তমানে দৈনিক ব্যান্ডউইডথ চাহিদা প্রায় ৯ টেরাবাইট, যার মধ্যে প্রায় ৭ টেরাবাইট সরবরাহ হয় দুটি সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে। বাকি অংশ আসে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত আইটিসি নেটওয়ার্ক থেকে।

সুযোগ আছে, তবে সতর্কতা জরুরি : ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ‘স্টারলিংককে ব্যান্ডউইথ দিতে হলে আগে দেশের নিজস্ব সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হবে। যদি আমরা সাবমেরিন কেবলের বাড়তি ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করতে পারি, তা হলে এটা হবে লাভজনক রপ্তানি। কিন্তু সে সক্ষমতা এখন কতটা আছে, সেটাই প্রশ্ন।’

তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, স্টারলিংককে ব্যান্ডউইথ দেওয়া মানে বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর আন্তর্জাতিক অবস্থানকে একধাপ এগিয়ে নেওয়া। তবে নিরাপত্তা, নীতিমালা এবং বাজারমূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো এখনও মূলত সমুদ্র তলদেশের সাবমেরিন কেবলের ওপর নির্ভরশীল। এই তারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ এনে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি) ব্যবহারকারীদের সেবা দেয়। কিন্তু এবার সেই চিরচেনা অবকাঠামোর বাইরে নতুন দিগন্ত খুলতে যাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের স্টারলিংক। স্টারলিংক মূলত পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা হাজার হাজার ক্ষুদ্র স্যাটেলাইটের এক বিশাল নেটওয়ার্ক। এই স্যাটেলাইটসমূহ মাটিতে থাকা ব্যবহারকারীকে সরাসরি ইন্টারনেট সংযোগ দেয়, কোনো তার ছাড়াই।

Leave a Reply

Scroll to Top