ফ্লোটিলা অভিযান: ইসরায়েলবিরোধী জনমতের প্রকাশ।


এই সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে– এমন বক্তব্যসহ একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। ঘোষণাটি এসেছে সরকার এ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পরপরই। ব্রিটিশ সরকার এবং ইতালির মতো ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো প্রভাব ফেললে তা হবে বেশ আগ্রহ-উদ্দীপক। পশ্চিমা বিশ্ব কি ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাববে?

লিভারপুলে অনুষ্ঠিত লেবার সম্মেলনে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন গৃহীত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে– ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে। প্রতিনিধিরা একটি প্রস্তাব সমর্থন করেছেন, যেখানে সরকারকে ‘গাজায় সংঘটিত গণহত্যা রোধে যুক্তিসংগত সব উপায় ব্যবহার করা’র আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের অস্ত্র ব্যবসা স্থগিত করারও আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকার আগে ইসরায়েলি গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের এক সপ্তাহ আগে লন্ডনে তারা একটি সন্দেহজনক বিবৃতি দিয়ে বলেছিল, ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে– তারা ‘এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি’। তারা আরও দাবি করেছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অস্ত্র ব্যবসায় মূলত গাজায় বোমা হামলায় ব্যবহৃত এফ-৩৫ বিমানের যন্ত্রাংশ মাত্র, এতে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়নি।

ইতালি আরেকটি দেশ, যেখানে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তর থেকে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। বিক্ষোভ মিছিল ইতালীয় বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে জনসাধারণ ফিলিস্তিনের জন্য ন্যায়বিচারের পক্ষে সোচ্চার এবং ইসরায়েলের অপরাধে ইতালির সমর্থনে ইতি টানার দাবি জানিয়েছেন।

গাজার অবরোধ ভাঙতে যাত্রা করা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ৫৮ জন ইতালীয় নাগরিক আছেন, যাদের মধ্যে সংসদ সদস্য কয়েকজন। ভূমধ্যসাগরে যাত্রাকালে ড্রোন আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার পর রোম নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজকে ফ্লোটিলা পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। তবে গাজার উপকূল থেকে ১৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে পৌঁছানোর পর ইতালীয় নৌবাহিনী ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পিছু হটে। প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ প্রেরিত স্প্যানিশ নৌ জাহাজ একই কাজ করেছিল। আর যেসব তুর্কি ড্রোন ফ্লোটিলা অনুসরণ করছিল তারা নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়।

ইউরোপের বহু দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে প্রতীকী স্বীকৃতি দিয়ে জনগণের অসন্তোষ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের জনগণ চায় জবাবদিহি। তারা স্পষ্টভাবে জানতে চায়– তাদের নির্বাচিত সরকার গণহত্যাকে সমর্থন করছে না। জনগণ প্রতীকী পদক্ষেপে বোকা হচ্ছে না। তারা তাদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চায় বাস্তব পদক্ষেপ।

যেমনটি আমি আগের একটি উপসম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম, ইউরোপের জন্য ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো ইইউ-ইসরায়েল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি বাতিল করা। তবে ইইউর একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে, যা হলো ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা। এ কারণে জোটের কার্যকারিতা এবং ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বাধাগ্রস্ত হয়। তবে গত মাসে তার স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইন বলেছিলেন, ‘এখন ঐকমত্যের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের বের করে আনার সময় এসেছে।’ যদি এই প্রয়োজনীয়তা বাতিল করা যায়, তাহলে ইসরায়েলের মুখে অবশ্যই চপেটাঘাত পড়বে।

ইউরোপীয় নেতারা যতই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখুন, এক পর্যায়ে তাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিতে হবে। এই সপ্তাহে ইতালীয় যুদ্ধজাহাজটি নৌবহর ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি তাঁর নাগরিকদের ফিরে আসতে বলেছিলেন। এ সময় তিনি ভণ্ডামি করে দাবি করেছিলেন, জনসাধারণের এ প্রচেষ্টা শান্তি বিঘ্নিত করার ঝুঁকি তৈরি করছে। কিন্তু ইতালীয় জনগণ তাতে বিশ্বাস করেনি। নৌবহরটি আটকে দেওয়ার পর তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ইতালির ইউনিয়নগুলো শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল।

জনঅসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে। জুন ও জুলাই মাসে গাজা অভিমুখী দুটি নৌবহর আটকে দেওয়া হয়েছিল। এতে কোনো কিছুই থামানো যায়নি। তবে এবারের ঘটনা ভিন্ন। এটি কেবল একটি ছোট পরিসরে কর্মীদের দিয়ে গাজায় সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা নয়। এই নৌবহরের পক্ষে বিস্তৃত জনসমর্থন গড়ে উঠেছে। মেলোনির প্রধানমন্ত্রিত্ব কি তেলআবিবে তাঁর বন্ধুদের খুশি করে টিকিয়ে রাখা যাবে, যেখানে সাধারণ ধর্মঘটে আরও অস্থিতিশীলতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে? ইউরোপীয় নেতাদের উচিত ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন নতুন করে ভেবে দেখা।

মানুষ আরও সংগঠিত ও কৌশলী হয়ে উঠছে। পুলিশের বর্বরতার ঘটনা ও গ্রেপ্তারের ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা ভয় পাচ্ছে না। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের অবশ্যই জানা উচিত, তাদের জনগণকে প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি দিয়ে বোকা বানানো যাবে না। তারা পরিবর্তন দেখতে চায়। নীতিনির্ধারকদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ইউরোপে জোয়ারের গতিমুখ উল্টে গেছে এবং পরবর্তী ধাক্কাটা ঘটবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

ড. দানিয়া কোলেইলাত খতিব: মার্কিন-আরব সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ; আরব নিউজ থেকে
সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

Leave a Reply

Scroll to Top