প্রিন্ট এর তারিখঃ মে ২৩, ২০২৫, ১২:৩০ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ মে ২০, ২০২৫, ২:৪১ অপরাহ্ণ
“পাঁচ মাস ধরে ফুলতলা চা-বাগান বন্ধ, কর্মহীন দেড় হাজার শ্রমিকের ঘরে নেই খাবার”
[caption id="attachment_1360" align="alignnone" width="600"]
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা-বাগান [/caption]
ফুলতলা চা-বাগানে ঢুকতেই রোদেলা আকাশ মুহূর্তেই ঢেকে গেল কালো মেঘে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আশ্রয় নেন বাগানের বন্ধ কার্যালয়ের বারান্দায়। সেখানেই দেখা মিলল শ্রমিক রাজকুমার রবিদাসের (৪০)।
পিত্তথলির রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজকুমার রবিদাস এক মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ, সেরে উঠতে অস্ত্রোপচার করাতেই হবে। এ জন্য দরকার ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু পাঁচ মাস ধরে কাজ না থাকায় টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
প্রায় পাঁচ মাস ধরে ফুলতলা বাগানটি বন্ধ। ফলে শ্রমিকেরা কর্মহীন; মজুরি ও রেশন পাচ্ছেন না। গত রোববার কথা হয় রাজকুমার রবিদাসের সঙ্গে। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বললেন, ‘ভালোই চলছিল বাগানটা। হঠাৎ করি কোম্পানি (বাগান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান) মজুরি-রেশন বন্ধ করি দিল। তবুও কয়েক মাস কাজ করি গেলাম। পেট খালি রাখি আর কত চলে। পরে নিজেরাই কাম বন্ধ করি দিলাম। কেউ বাগানটা খুলে দেয় না। চোখের সামনে বাগানটা নষ্ট হচ্ছে দেখে কষ্ট লাগে।’
৮৯৬ সালে স্থাপিত ফুলতলা চা-বাগানের অবস্থান মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নে। পাঁচ মাসের বেশি সময় বাগান বন্ধ থাকায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। এ পরিস্থিতিতে বাগানের শ্রমিকদের কেউ কেউ আশপাশের বিভিন্ন বাগানে গিয়ে স্বল্প মজুরিতে চায়ের কুঁড়ি তোলেন। পেশা বদলে কেউ কেউ বাইরে দিনমজুরের কাজ করছেন।
রোববার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বাগানের কারখানা ও প্রশাসনিক কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। শ্রমিকদের আনাগোনা নেই। তবে এখনো ভাঙাচোরা একটি কোয়ার্টারে আছেন বাগানটির প্রধান করণিক আবদুল ওয়াদুদ। বাগানটির গুরুত্বপূর্ণ নথি, যন্ত্রপাতি খোয়া যাওয়ার আশঙ্কায় তিনিসহ আরও দু-তিনজন কর্মচারী এখনো বাগানে আছেন।
বাগানের শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, ফুলতলা বাগানের এলবিনটিলা ফাঁড়ি নামে পাশে আরেকটি বাগান রয়েছে। দুটি মিলিয়ে বাগানের মোট জমির পরিমাণ ২ হাজার ৬৩৬ একর। একসময় ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বাগানটি পরিচালনা করত। পরবর্তী সময়ে ‘দ্য নিউ সিলেট টি এস্টেটস লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে বাগানটি ইজারা নিয়ে পরিচালনা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় সিলেটের খাদিমনগরে। এটির চেয়ারম্যান মো. রফিক সপরিবার যুক্তরাজ্যে থাকেন। বাগানে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক আছেন।
চার-পাঁচ বছর ধরে ফুলতলা বাগানটি ধুঁকে ধুঁকে চলছিল বলে জানান ১০-১২ জন শ্রমিক। তাঁদের ভাষ্য, শ্রমিকেরা নিয়মিত মজুরি পাচ্ছিলেন না। এরই মধ্যে গত বছরের ৯ আগস্ট কর্তৃপক্ষ নানা কারণ দেখিয়ে দুই মাসের জন্য বাগানের সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। তখন চায়ের ভরা মৌসুম চলছিল। এ পরিস্থিতিতে চা নষ্টের আশঙ্কা ও জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনা করে শ্রমিকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে বাগানটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি সংকট নিরসনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এতেও সংকট ঘোচেনি। চা বিক্রিতে জটিলতা সৃষ্টির কারণে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি আটকা পড়ে। একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও। এ পরিস্থিতিতে বাগানের শ্রমিকেরা ১৫ ডিসেম্বর থেকে কাজ বন্ধ করে দেন।
[caption id="attachment_1361" align="alignnone" width="600"]
বন্ধ কারখানার গেইট[/caption]
বাগানটিতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি রবি বুনারজির। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অতীতে এ রকম অব্যবস্থাপনা দেখিনি। এমনিতেই ১৭ সপ্তাহের মজুরি-রেশন বাকি। বাগান বন্ধের পর কয়েক মাস ধরে খুব বাজে অবস্থা। শ্রমিকদের কাজ নাই, ঘরে খাবার নাই। প্রশাসনের কাছে গিয়েছি, জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েছি। কার ভরসায় কাজে নামব?’
আপাতত মালিকপক্ষের কেউই শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না উল্লেখ করে প্রধান করণিক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ভরা মৌসুমে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বাগানের শুধু শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহের মজুরি পরিশোধে ২২-২৩ লাখ টাকা লাগে। বাকি সময়ে সপ্তাহে লাগে ১৭-১৮ লাখ টাকা। কাজ শুরু হলেও চা প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং নিলামে বিক্রিতে মাসখানেক সময় লেগে যায়। এ সময়ে শ্রমিকদের চার সপ্তাহের (এক মাসে চার সপ্তাহ হিসাবে) মজুরি লাগে। ওই টাকার জোগান কীভাবে হবে, সেটিই বড় বিষয়।
ফুলতলা বাগানটি চালুর ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন চৌধুরী গতকাল সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে বলেন, রোববার ফুলতলাসহ কয়েকটি চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের ঢাকায় চা-বোর্ডের চেয়ারম্যানের বৈঠক হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ফুলতলা বাগানের সমস্যার সমাধানে তিনি ২৭ মে জুড়ী উপজেলা পরিষদের অডিটরিয়ামে বৈঠকে বসবেন। এ সময় চা-শ্রমিকের প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
তবে ওই বৈঠকের বিষয়ে লিখিতভাবে কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেছেন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বাবলু সূত্রধর। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তাঁদের লিখিতভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে ফুলতলা বাগানটি আবার চালুর ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
Copyright © 2025 সত্যের পথে. All rights reserved.