প্রিন্ট এর তারিখঃ অক্টোবর ৭, ২০২৫, ৪:০৮ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫, ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ
পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে হাসিনা আমলের প্রকল্প থামছে না কেন

বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্প নিয়ে উন্নয়নের নামে দেশব্যাপী প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করা হয়েছে। সেই ধারা এখনো বন্ধ হয়নি। এ রকম একটি প্রকল্প নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ, গীতি আরা নাসরীন, শায়ের গফুর, ফিরোজ আহমেদ, সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, পাভেল পার্থ, আদিল মুহাম্মদ খান, সামিনা লুৎফা, আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান
[caption id="attachment_4674" align="aligncenter" width="600"]
রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল ধ্বংস করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে ছবি: সত্যের পথে[/caption]
বিগত কয়েক দশকে বিদেশি ঋণে নেওয়া বেশির ভাগ প্রকল্পে পরিবেশ ও জনজীবনের তোয়াক্কা না করেই স্বৈরাচারী কায়দায় ঋণের বোঝা জনগণের ওপর তুলে দিয়ে একের পর এক ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কোনো রকম সার্বিক পরিকল্পনা ও অংশীজনের মতামত গ্রহণ না করেই নেওয়া এসব প্রকল্প জনজীবনে ভোগান্তি ও মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আসছে।
সব ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা ভঙ্গ করে বিকল্প থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় ঋণে সুন্দরবন ঘেঁষে তৈরি করা হয় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদেশি বিনিয়োগে দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইপিজেড, যেখানে পোশাক কারখানায় সস্তা শ্রম দিয়ে যান দেশের মানুষ। আর ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামতে থাকে, বর্জ্যে দূষিত হতে থাকে দেশের মাটি, নদী–নালা, খাল–বিল।
পরিবেশ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সব সময় এ ধরনের বিপরীতমুখিতা তৈরি করে দেশের জনজীবন পর্যুদস্ত করে তোলা হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক যে লাভের কথা তুলে পরিবেশ ধ্বংসের যে ন্যায্যতা বা সমর্থন আদায় করা হয়েছিল, একটু গভীর পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যে এসব বয়ান আসলে জনগণের চোখে ধুলা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত তাদের গবেষণায় বাংলাদেশের সড়ক নির্মাণ ব্যয় ভারত ও চীনের থেকে বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকাকে উল্লেখ করেছে।
ঋণ কিংবা বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে নেওয়া এসব প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিতে লাভ হয় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও আমলা, প্রকল্প পরামর্শক, দেশি–বিদেশি কোম্পানি ও তাদের সহযোগীদের। আর ঋণের বোঝা এসে পড়ে জনগণের ঘাড়ে। বৈদেশিক সাহায্যের নামেও যেসব প্রকল্প আসে, সেগুলোর বিনিময়েও নানাবিধ আর্থিক কিংবা অন্যান্য সুবিধা দিতে হয় সরকারকে।
পরিবেশের কথা বাদ দিলেও শুধু অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক নানা প্রকল্পও কারচুপি করে লাভজনক দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বিগত দশকগুলোতে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে কী ধরনের অসাধু প্রক্রিয়ায় কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২০২৪ সালের জানুয়ারির টোল ও ট্রাফিক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যবহারকারী যানবাহনের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাইভেট কার। মেগা প্রজেক্টের বিনিয়োগ ফেরত আনা ও প্রাইভেট কার চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এই সংযোগ সড়কের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এই এলাকায় বিদ্যমান অতিব্যস্ত রাস্তাগুলোর উপযোগিতা নষ্ট করবে, যেটা খোদ এই প্রকল্পের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে এই এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প ওঠানামার কারণে সার্ক ফোয়ারা, বাংলা মোটর, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, নীলক্ষেত ও পলাশীর মোড়ে ট্রাফিক জ্যাম আরও অনেক বেড়ে যাবে। প্রাইভেট কারে চলাচলকারী ৫ শতাংশ মানুষের জন্য নেওয়া মেগা প্রজেক্টের কুফল ভোগ করবেন ৯৫ শতাংশ মানুষ। এটা কি গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার ভেবে দেখবে না?
■ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২০২৪ সালের জানুয়ারির টোল ও ট্রাফিক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যবহারকারী যানবাহনের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাইভেট কার। ■ উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পান্থকুঞ্জ পার্কের আনুমানিক দুই হাজার পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ নিধন এবং হাতিরঝিল জলাধার ভরাট করে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগের কারণে হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ পার্কের পরিবেশ ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে। এবার কাঁঠালবাগান-কাঁটাবন-নীলক্ষেত-পলাশীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিবহনব্যবস্থা সীমাহীন সংকটে পড়বে।
পলাশীর মোড়ে যেখানে র্যাম্প নামানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার এক পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সরাসরি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখ ও আরেক পাশে ইডেন কলেজসহ আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। উচ্চ গতিসম্পন্ন এক্সপ্রেসওয়ের যানবাহন যখন এই এলাকায় প্রবেশ করবে, তা সমগ্র এলাকার যানজট পরিস্থিতি আরও তীব্র হবে—সেটা অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে।
প্রকল্পের অর্থনৈতিক কারসাজি
ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের মূল প্রকল্পটি (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প) ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদন পায়। কিন্তু অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে তিন বছরের এই প্রকল্প এক যুগ পার হলেও সম্পন্ন করা যায়নি। বিদেশি কোম্পানির ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা (প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ) এবং ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফিন্যান্সিং (ভিজিএফ) হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা (প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৭ শতাংশ)।
কিন্তু এর বাইরে উড়ালসড়কের জন্য জমি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরানো ও পরামর্শকদের ব্যয় মেটানোর জন্য ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকার ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ নামে আরেকটি প্রকল্প নেয় সেতু বিভাগ যার পুরো ব্যয় বহন করবে দেশের জনগণ।
লিংক প্রকল্পের ব্যয় যুক্ত করলে দেখা যায় যে সর্বমোট প্রাক্কলিত ১৩ হাজার ৮৫৭ দশমিক ৫৭ কোটি টাকার মধ্যে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ, মানে ৭ হাজার ৩৩০ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা বহন করবে বাংলাদেশের জনগণ। অথচ পিপিপি অথরিটির ২০১০ সালের ভিজিএফ ফান্ডিংয়ের সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা আছে যে সরকারের ভিজিএফ ফান্ডিং ৩০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। প্রকল্পের ব্যয়বহুল খাতগুলো আলাদা লিংক প্রকল্পের আওতায় এনে পিপিপি প্রকল্পকে লাভজনক করে দেখানোর এই প্রচেষ্টা জনগণের সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয়
পান্থকুঞ্জ নিয়ে ২০১৪ সালে করা একটি রিট পিটিশনে উচ্চ আদালত পান্থকুঞ্জকে মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে উন্মুক্ত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে, পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়ে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করা হয়।
ওই রায়ের মহামান্য আদালত ‘খোলা জায়গা’র সংজ্ঞা হিসেবে বলেছিলেন, খোলা জায়গার সর্বনিম্ন অংশ হতে আকাশ পর্যন্ত বাধা তৈরি করে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়ক নির্মাণের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এখানে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। এটা সরকারি সংস্থাগুলো কর্তৃক আদালত অবমাননার শামিল।
এ ছাড়া হাতিরঝিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও মাস্টারপ্ল্যানে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত করা হাতিরঝিলে যেকোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, ২০০০ সালে প্রণীত ‘মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ভঙ্গ করার শামিল মর্মে রায় প্রদান করেছেন।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পান্থকুঞ্জ পার্কের আনুমানিক দুই হাজার পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ নিধন এবং হাতিরঝিল জলাধার ভরাট করে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মূলনীতি যদিও আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়, তারপরও সংবিধান সংস্কার কমিশন এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য পরিবেশের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
Sotterpothe