[caption id="attachment_5924" align="aligncenter" width="600"]
শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য হাতছানি দেয় পর্যটকদের ছবি: সত্যের পথে[/caption]
গোধূলির আলো নিভে এলে গারো পাহাড় যেন রূপ নেয় অন্য এক জগতে। শাল–গজারির বনের ফাঁক গলে চাঁদের আলো নেমে আসে পাহাড়ি টিলায়, ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসে নীরব সীমান্তপথে। অথচ এই সৌন্দর্য চোখে দেখার সুযোগ থাকে না ভ্রমণপিপাসুদের। আবাসনসংকটে শেরপুরের গারো পাহাড়ে সন্ধ্যার আগেই ফেরার তাড়া থাকে পর্যটকদের। ফলে অপরূপ রাতের পাহাড় অদেখাই রয়ে যায় তাঁদের কাছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আবাসনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ গড়ে না ওঠায় তিন দশকেও সমৃদ্ধ হয়নি জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলো। খাবার, যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা ভালো থাকলেও জেলা শহরের বাইরে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ আবাসন নেই। নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁও স্থলবন্দর দিয়েও ভারত যাতায়াত হয়, অথচ সেখানেও নেই রাতযাপনের সুবিধা।
শেরপুরের সীমান্তঘেঁষা গারো পাহাড়ে রয়েছে গজনী অবকাশ কেন্দ্র, মধুটিলা ইকোপার্ক, পানিহাটা-তাড়ানি, রাজার পাহাড়, রাবারবাগানসহ নানা দর্শনীয় স্থান। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলা জনপথ। সীমান্ত থেকে ভারতীয় পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, পাহাড়ি জীববৈচিত্র্যও টানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। কিন্তু রাতযাপনের কোনো সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে এক দিনের ভ্রমণেই শেষ করতে হয় তাঁদের।
সম্প্রতি ফরিদপুর থেকে ঘুরতে এসেছিলেন তরুণ পর্যটক নুরননবী আহমেদ। তিনি সত্যের পথকে বলেন, ‘আমরা সাজেক বা বান্দরবানে গেলে তিন দিনের প্ল্যান করি। এখানকার (শেরপুরের) প্রাকৃতিক পরিবেশও সুন্দর, কিন্তু এত জায়গা এক দিনে দেখে শেষ করা যায় না। রিসোর্ট হলে সারা বছর ভিড় থাকত।’
[caption id="attachment_5925" align="aligncenter" width="600"] শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের প্রকৃতির মিলনমেলা। ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনী অবকাশ কেন্দ্রে ছবি: সত্যের পথে[/caption]
নৈসর্গিক দৃশ্য ও বন আকর্ষণ করে দর্শনার্থীদের
ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নে ১৯৯৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে ওঠে গজনী অবকাশ কেন্দ্র। সীমান্তঘেঁষা পর্যটনকেন্দ্রটি গারো পাহাড়ের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য বিশেষভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল। শুরুতে শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এবং বিদেশ থেকেও পর্যটকের ভিড়ে এই কেন্দ্র মুখর হতো। গজনী অবকাশ কেন্দ্রের জায়গা, পাহাড়ি নৈসর্গিক দৃশ্য ও বনভূমি দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে মধুটিলা ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয় বন বিভাগের উদ্যোগে। নালিতাবাড়ী সীমান্তে ৩৯০ একর জায়গাজুড়ে তৈরি এই ইকোপার্কে রয়েছে পাহাড়ি বন, লেক, ওয়াচ টাওয়ারসহ পর্যটকদের জন্য কিছু সীমিত কার্যক্রম। দুটি কেন্দ্রই শেরপুরকে পর্যটন মানচিত্রে পরিচিতি দিয়েছে এবং পর্যটকদের জন্য দিনের বেলায় একাধিক কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করেছে।
কিন্তু পরবর্তী দশকে গজনী ও মধুটিলায় পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। ফলে পর্যটনের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। মধুটিলায় বিশেষ কোনো বিনোদনমূলক রাইড, আধুনিক রিসোর্ট বা আবাসিক সুবিধা নেই। অবশ্য গজনীতে সম্প্রতি ঝুলন্ত ব্রিজ, কেব্ল কার এবং জিপলাইন চালুর পর নতুন করে কিছু পর্যটকের আগমন বেড়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।
সীমান্ত সড়ক ধরে পর্যটকেরা এক দিনে রাজার পাহাড়, বারোমারী মিশন, সুতানালী দীঘি, নাকুগাঁও স্থলবন্দরসহ আরও কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরতে পারেন। তবে এতগুলো জায়গা এক দিনে ঘুরে দেখা অসম্ভব। আবাসন ও রাতযাপনের সুযোগ না থাকায় দর্শনার্থীরা সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে যেতে বাধ্য হন।
মধুটিলা ইকোপার্কের ইজারাদার এরশাদ আলী বলেন, ‘পর্যটকেরা দিনের বেলা ভিড় করেন, কিন্তু রাতে থাকতে পারেন না। আবাসিক–সুবিধা হলে পর্যটন অনেক এগিয়ে যেত।’
আবাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাগিদ
শেরপুর জেলা শহরে কয়েকটি মাঝারি মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেগুলোতে সাধারণ পর্যটকেরা রাত যাপন করতে পারেন। তবে জেলা শহর থেকে গারো পাহাড়ের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র গজনী অবকাশ বা মধুটিলা ইকোপার্কে যেতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। ফলে পর্যটকেরা দিনে সেখানে ঘুরে এসে আবার শহরে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এতে পাহাড়ি এলাকায় রাতের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ মেলে না।
অন্যদিকে সীমান্তঘেঁষা নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় তেমন কোনো আধুনিক আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট বা মোটেল নেই। এমনকি নাকুগাঁও স্থলবন্দরেও নেই কোনো অতিথিশালা বা থাকার জায়গা। এতে সীমান্ত দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রী এবং পর্যটক উভয়ের জন্যই দুর্ভোগ তৈরি হয়।
রাজধানীর উত্তরা থেকে সপরিবার ঘুরতে আসা গৃহিণী নাসরিন সুলতানা বলেন, ‘আমরা শেরপুরে এসেছি গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। দিনের বেলায় সব জায়গা ঘুরে দেখাটা সুন্দর অভিজ্ঞতা ছিল, তবে রাতে থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ফিরে যেতে হচ্ছে।’ এই পর্যটক বলেন, এখানে রিসোর্ট বা আবাসিক হোটেল থাকলে পুরো পরিবারের সঙ্গে আরামদায়কভাবে এক দিনের বেশি অবস্থান করতে পারতেন।
[caption id="attachment_5926" align="aligncenter" width="600"] বন বিভাগের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে মধুটিলা ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয় ছবি: সত্যের পথে[/caption]
পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ট্যুরিস্ট পুলিশ নিয়োগের দাবি অনেক দিনের। বর্তমানে বিজিবি ক্যাম্প থাকলেও পর্যটকেরা বিশেষায়িত নিরাপত্তা চান। স্থানীয় মানুষেরা মনে করেন, উপজেলাগুলোতে যদি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নিরাপদ ও আধুনিক আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেত, তাহলে গারো পাহাড়ের পর্যটন খাত দ্রুত বিকশিত হতো।
জানতে চাইলে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশরাফুল আলম বলেন, গারো পাহাড়ে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটকদের থাকার সুবিধার্থে ইতিমধ্যে রংটিয়া মোড়ে ৫ একর জমি দেখা হয়েছে। সেখানে পর্যটন মোটেল করার জন্য ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
পর্যটকদের নিরাপত্তা বিষয়ে ইউএনও বলেন, গজনী অবকাশ কেন্দ্রে মধ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ঝিনাইগা থানার পুলিশ নিয়মিত সেখানে টহল দেয়। সেখানে গ্রাম পুলিশও মোতায়ন করা হয়েছে। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।