নবুওয়তের আলোয় দাওয়াতের সূচনা ও অন্তরায়

                                                                                         প্রতীকী ছবি

সুরা মুদ্দাসসির নাজিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) পথহারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান শুরু করেন। সে সময় কুরাইশদের একমাত্র ধর্ম ছিল মূর্তি ও প্রতিমাপূজা। তাদের হজ্জ ছিল কেবল পিতৃপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ, যেখানে কোনো সঠিক বিধান অবশিষ্ট ছিল না। আত্মমর্যাদা আর বংশগৌরব ছাড়া তাদের চরিত্রে উৎকর্ষ ছিল না; সমস্যার সমাধানও হতো কেবল তলোয়ারের মাধ্যমে।

তবুও মক্কা ছিল সমগ্র আরবের ধর্মীয় কেন্দ্র, কারণ এখানকার অধিবাসীরাই কা‘বার খাদেম ও তত্ত্বাবধায়ক। ফলে এ শহরে সংস্কারমূলক দাওয়াত শুরু করা ছিল অতীব কঠিন ও সংবেদনশীল কাজ। এ জন্য নবুওতের প্রাথমিক পর্যায়ে দাওয়াত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল সতর্কতা ও গোপনীয়তার সঙ্গে, যাতে আকস্মিক কোনো সংঘাত বা উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়।

ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দল

এটা খুবই স্বাভাবিক যে রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম দাওয়াত পেশ করেছিলেন তাঁর নিকটতম ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কাছে।

এদের মধ্যে ছিলেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.), দাস মুক্ত যায়দ বিন হারিসা, চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবু তালিব এবং প্রিয় সাহাবি আবু বকর সিদ্দীক (রা.)। প্রথম আহবানে তাঁরা সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে আবু বকর (রা.)-এর প্রচেষ্টায় ইসলামের পতাকাতলে আসেন উসমান ইবনে আফফান (রা.), জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.), সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ও তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.)। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন বিলাল হাবশী (রা.) ও আরও অনেকে।

এর মধ্যে ছিলেন আবূ উবায়দাহ আমির ইবনে জাররাহ (রা.), আবু সালামাহ (রা.), আরক্বাম ইবনে আবিল আরক্বাম (রা.), উসমান ইবনে মাযউন (রা.) ও তাঁর ভ্রাতৃদ্বয়, সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা.) ও তাঁর স্ত্রী, ফাতিমাহ বিনতে খাত্তাব (রা.), খব্বাব ইবনে আরাত (রা.), জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.) ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস, খালিদ ইবনে সাঈদ (রা.) ও তাঁর পরিবার, নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) প্রমুখ।

কুরাইশ ছাড়াও অন্য গোত্র থেকে ইসলাম গ্রহণ করেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), সুহাইব রূমী (রা.), আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) ও তাঁর পরিবার, আমির ইবনে ফুহাইরাহ (রা.) প্রমুখ। নারী সাহাবিয়াদের মধ্যে উম্মু আইমান (রা.), উম্মুল ফযল লুবাবাহ (রা.), আসমা বিনতে আবূ বকর (রা.) প্রাথমিক পর্যায়েই ইসলাম কবুল করেন।

গবেষণা অনুযায়ী, প্রাথমিক যুগে পুরুষ ও নারী মিলিয়ে প্রায় ৩৩০ জন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তবে এদের সবাই প্রকাশ্য দাওয়াতের আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।

প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রথম আদেশ

মুমিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি দৃঢ় দল গড়ে উঠলে, এবং ইসলাম কিছুটা শক্তি অর্জন করলে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দিতে আদেশ করা হলো। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয় আল্লাহর বাণী:

﴿وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ﴾

“আর তুমি সতর্ক কর তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের।”

সূরা আশ-শু‘আরার এ আয়াতের আগে মূসা (আ.)-এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যাতে তাঁর নবুওতের সূচনা, বনি ইসরাঈলকে হিজরতের মাধ্যমে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করা এবং ফেরাউনের ধ্বংসের কাহিনি উল্লেখিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাদেরকে শিক্ষা দেওয়া যে প্রকাশ্য দাওয়াতের পর মিথ্যার সঙ্গে হকের সংঘাত অনিবার্য, এবং সত্যের অনুসারীরা নির্যাতন-অত্যাচারের সম্মুখীন হবে।

একই সঙ্গে এ সুরায় আরও বহু নবী-রাসুলকে অস্বীকারকারী জাতির—যেমন নুহ (আ.), আদ, সামুদ, ইবরাহীম (আ.), লুত (আ.)-এর সম্প্রদায় ও আসহাবুল আইকার—পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে যে যারা সত্য অস্বীকার করে তারা অবশ্যম্ভাবীভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, আর মুমিনরা বিপদের মাঝেও আল্লাহর রহমতে রক্ষা পায়।

আত্মীয়-স্বজনদের নিকট প্রচারের নির্দেশ

প্রথম সম্মেলন : পবিত্র কোরআনের আয়াত-

﴿وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ﴾

“আর তুমি সতর্ক কর তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের” (আশ-শু‘আরা, আয়াত : ২১৪)

এ আয়াত অবতীর্ণ হলে রাসুলুল্লাহ বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের প্রায় ৪৫ জনকে নিয়ে প্রথম সম্মেলনের আয়োজন করেন। এখানে আবু লাহাব কড়া আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, আত্মীয়স্বজনদের পক্ষে সমগ্র আরবের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়; বরং পরিবারের লোকজনই তাঁর বিরোধিতা করবে। তাঁর এই আস্ফালনের কারণে নবী (সা.) নীরব থাকেন এবং সম্মেলন ব্যর্থ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় সম্মেলন : পরে পুনরায় আত্মীয়স্বজনদের ডেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর প্রশংসা ও তাওহীদের ঘোষণা দিয়ে বলেন, তিনি বিশেষভাবে তাঁদের এবং সাধারণভাবে সমগ্র মানবতার জন্য প্রেরিত রাসুল। তিনি মৃত্যুর অনিবার্যতা, কিয়ামতের পুনরুত্থান ও জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, এবং জান্নাত-জাহান্নামের বাস্তবতা বর্ণনা করেন।

এ সময় আবু ত্বালিব সমর্থন জানিয়ে বলেন, তিনি নবী (সা.)-কে রক্ষা করবেন ও সহানুভূতি দেখাবেন, যদিও পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করবেন না। অন্যদিকে আবু লাহাব পুনরায় তীব্র বিরোধিতা করে। তখন আবু ত্বালিব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন, প্রাণ থাকা পর্যন্ত তিনি তাঁর ভাতিজাকে রক্ষা করবেন।

হজ্জ যাত্রীগণকে বাধা দেয়ার বৈঠক

কুরাইশরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, কারণ হজ্জের মৌসুম ঘনিয়ে এলো। তাঁরা আশঙ্কা করল, মুহাম্মাদ (সা.) হজ্জযাত্রীদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করবেন। তাই কীভাবে তাঁকে মানুষদের কাছে ছোট করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে ওলিদ ইবন মুগীরার ঘরে সমবেত হলো।

অনেকে তাঁকে কাহিন, পাগল, কবি বা যাদুকর বলার প্রস্তাব দিলেও, ওলিদ প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করলেন। অবশেষে তিনি বললেন, তাঁর বাণী অতি প্রভাবশালী, মধুর ও দৃঢ়মূল। তবে বিরোধিতার অজুহাত হিসেবে সর্বোচ্চ তাঁকে যাদুকর বলা যেতে পারে, কারণ তাঁর কথায় পরিবার-গোত্রে বিভেদ সৃষ্টি হয়। সবাই এই সিদ্ধান্তে একমত হলো। এ নিয়েই সূরা মুদ্দাসসিরের ১১–২৬ আয়াত নাজিল হয়, যেখানে ওলিদের চিন্তা-ভাবনা ও অহংকারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এরপর থেকে মক্কার কাফিররা হজ্জযাত্রীদের বিভ্রান্ত করতে পথে পথে নবী (সা.) সম্পর্কে নানা অপবাদ ছড়াতে থাকে। বিশেষত আবু লাহাব এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। তবে ফল হলো উল্টো—হজ্জ শেষে প্রত্যাগতরা মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে অবগত হয়ে নিজ নিজ অঞ্চলে বিষয়টি ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই ইসলামের বার্তা সমগ্র আরব জাহানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

(আর রাহীকুল মাখতুম অবলম্বনে)
-[চলবে… ইনশাআল্লাহ]

সংকলক: প্রবন্ধিক ও অনুবাদক

আবিদ হাসান

Scroll to Top