

জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, স্বাক্ষরকারী দলগুলো এই সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলতে পারবে না; তারা সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। এই সনদ সংবিধানে যুক্ত করা হবে। এগুলোসহ সনদ বাস্তবায়নে মোট সাতটি বিষয়ে অঙ্গীকার করবে দলগুলো।
অবশ্য সদন বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
বাস্তবায়নের পদ্ধতি সনদের অংশ হবে না। বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। তবে আজকের আলোচনা থেকে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে একটি ঐকমত্য হবে বলে আশা করছে কমিশন। ঐকমত্য না হলেও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে নিজেরা একটি সুপারিশ দেবে কমিশন।
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর জুলাই সনদ ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের সুপারিশ—এ দুটি দলিল রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছে পাঠানো হবে। পরে দলগুলোর সই করার মধ্য দিয়ে সনদ চূড়ান্ত রূপ পাবে।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। সনদের তিনটি ভাগ থাকবে। প্রথম ভাগে সনদের পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে থাকছে সনদ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকারনামা।
গত ২৯ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দলগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক খসড়া সংশোধন করে গত ১৬ আগস্ট ‘সমন্বিত খসড়া’ দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
সমন্বিত খসড়ায় জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়া; সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না—এমন বিধান এবং সনদের ব্যাখ্যার ভার সুপ্রিম কোর্টের ওপর দেওয়াসহ মোট আটটি বিষয়ে অঙ্গীকার করার কথা উল্লেখ ছিল। তবে এই তিন বিষয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি ছিল। সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় এই তিনটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সাত বিষয়ে অঙ্গীকার
সমন্বিত খসড়ায় আটটি বিষয়ে অঙ্গীকার করার কথা বলা হয়েছিল। চূড়ান্ত খসড়ায় সাতটি বিষয়ে অঙ্গীকার করার কথা বলা হয়েছে।
১. সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংবিধানের ওপরে জুলাই সনদের প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি সংশোধন করা হয়েছে। এর পরিবর্তে বলা হয়েছে, দলগুলো এমন অঙ্গীকার করবে যে জনগণের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করছে। তাই এই সনদ সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।
২. সমন্বিত খসড়ায় বলা হয়েছিল, সনদের বৈধতা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এখানে পরিবর্তন আনা হয়েছে। চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, দলগুলো এভাবে অঙ্গীকার করবে যে দলগুলো সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। উপরন্তু সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে দলগুলো আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
৩. ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।
৪. দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৫. গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
৬. সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে।
৭. যেসব সংস্কার প্রস্তাব অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
এই সাত বিষয়ে অঙ্গীকার করে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করবে।
চূড়ান্ত খসড়ায় সুপ্রিম কোর্টের ওপর সনদের ব্যাখ্যার ভার দেওয়ার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। সমন্বিত খসড়ায় বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অংশে একটি ভূমিকা ছিল। এটি নিয়ে বিএনপির আপত্তি ছিল। এর কিছু অংশ নিয়ে এনসিপিরও আপত্তি ছিল। চূড়ান্ত খসড়ায় সে ভূমিকা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আজ আলোচনা
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আজ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে এ আলোচনা হওয়ার কথা। গতকাল বুধবার কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দুই পর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। এবার আলোচনা হবে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে। বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামতও নেওয়া হয়েছে।
সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এই তিন দল তিন ধরনের পদ্ধতির কথা বলেছে। সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির প্রক্লেমেশন (রাষ্ট্রপতির ঘোষণা) বা গণভোটের মাধ্যমে এবং এনসিপি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন চেয়েছে। এর বাইরে অন্তত ১০টি দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন মনে করে, সংবিধান–সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির সুপারিশ করা হবে। এটি সনদ বাস্তবায়নের সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আর সংবিধান–সম্পর্কিত নয়, এমন প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। তবে আজকের আলোচনায় কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো সুপারিশ রাখা হবে না বলে জানা গেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে যেসব প্রস্তাব এসেছে, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে জানানো হবে। দলগুলো একে অন্যের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা কী মত দিয়েছেন, সেটাও জানতে পারবে। আলোচনায় দলগুলো নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে একটি ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছাতে পারবে বলে কমিশন আশা করছে।