[caption id="attachment_4368" align="aligncenter" width="600"]
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মুনির সাতৌরীর নেতৃত্বে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন : পিআইডি[/caption]
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২২ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক পৌঁছবেন। এই প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের সাথে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
প্রধান উপদেষ্টার নিউ ইয়র্ক সফরের ওপর আলোকপাত করে গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ সব কথা জানান। তিনি বলেন, আমরা একটা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনীতিবিদদের কাছেই দেশ পরিচালনার ভার হস্তান্তর করবে। তাই এবার প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধিদলে রাজনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ২৩ সেপ্টেম্বর শুরু হতে যাওয়া জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের সাধারণ বিতর্ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিবেন। এ অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি ২২ সেপ্টেম্বর একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে নিউ ইয়র্কে পৌঁছবেন। এ বছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি’ বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে কেন্দ্র করে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে এমন উচ্চ পর্যায়ের সভা আয়োজন এবারই প্রথম। গত বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা সব অংশীদারের অংশগ্রহণে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক এমন একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা আয়োজনের প্রস্তাব করেছিলেন। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সর্বসম্মতিক্রমে একটি রেজ্যুলুশনের মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের সভা থেকে যেন রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত সমাধানের একটি কার্যকর ও সময়সীমানির্ভর পরিকল্পনা উঠে আসে, তার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদার ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের প্রথমবারের মতো একটি সংলাপের আয়োজন করে। এ ছাড়া জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে কক্সবাজারে এক সাথে ইফতার করেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সঙ্কটের উদ্ভবের পরেও সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা যে বিশ্বব্যাপী আলোচ্য সূচিতে পিছিয়ে পড়েনি, প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘে উচ্চ পর্যায়ের সভার আয়োজন এবং জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সফর তারই প্রমাণ।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ আলোচনা পর্বে বক্তব্য রাখবেন। তিনি তার বক্তব্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আশা-আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত এক বছরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সংস্কার ও আগামী দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘাত, রোহিঙ্গা সঙ্কট, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশসমূহ হতে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর এবং ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের যুদ্ধ বিরতি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তার বক্তব্যে উঠে আসবে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, চলতি বছর একই সাথে বিশ্ব যুব কর্মসূচির ৩০ বছর পূর্তি এবং নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক ঐতিহাসিক রেজ্যুলুশনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে, যাতে প্রধান উপদেষ্টা যোগ দেবেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কারণে আমরা আজ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যার অগ্রভাগে ছিল মূলত দেশের তরুণ ও যুব সমাজ। এ ছাড়া চলমান নানামুখী সংস্কার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থেকে অন্যতম অনুঘটক হিসেবেও দেশের তরুণ সমাজ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের স্বাগত অভ্যর্থনা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যর্থনাসহ প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। এ সময়ে অনেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তেও হয়ে থাকে। অনেকগুলো বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের বর্তমানে অন্যতম অগ্রাধিকার হলো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা এবং সুষ্ঠুভাবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। এ প্রেক্ষাপটে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত আমাদের চলমান সংস্কার কার্যক্রম এবং গণতন্ত্র অভিমুখে আমাদের যাত্রাকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন আমাদের কাছে একটি সুযোগ।
আশা করছি, অপ্রীতিকর কিছু হবে না : সম্প্রতি বিদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রতি বিক্ষোভ প্রদর্শনের মতো ঘটনা জাতিসঙ্ঘের সামনে হলে করণীয় কী জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, বিক্ষোভ হবে, এটা আমি ধরে নিচ্ছি। কারণ, এটা ঠেকানোর উপায় আমাদেরও নেই, যুক্তরাষ্ট্রেরও নেই। আমাদের বুঝতে হবে পশ্চিমের দেশগুলোতে সেøাগান দেয়া, রাস্তায় মিছিল করা, প্রতিবাদ করা একটি নাগরিক অধিকার। তারা সফরকারী প্রতিনিধিদলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়। সম্প্রতি লন্ডনে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। খবর যা এসেছে, সব কিছু পুরোপুরি সত্য না। যেমন, যে গাড়িটা আক্রান্ত হয়েছে, সেই গাড়িতে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ছিলেন না। তিনি অন্য একটা গাড়িতে ছিলেন। আর নিউ ইয়র্ক পুলিশের এ ব্যাপারে বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি আশা করছি, অপ্রীতিকর কোনো কিছু হবে না।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সাক্ষাৎ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কিছু মহল এখনো ভোট পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন নিশ্চিত করতে অটল রয়েছে। আমরা আগামী রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির শুরুতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।
গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মুনির সাতৌরির নেতৃত্বে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের (এমইপি) একটি প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এ অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে
এমইপি সদস্যদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা এরই মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করেছি। রমজানের আগেই ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, তরুণ ভোটাররা এবার রেকর্ড সংখ্যায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, কারণ ১৫ বছরেরও বেশি সময় পর অনেকেই প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সূচনা বয়ে আনবে। এটি আমাদের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে জাতির জন্য এক নতুন যাত্রা।
এক ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা ও ইউরোপীয় আইনপ্রণেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অব্যাহত সমর্থন এবং চলমান রোহিঙ্গা মানবিক সঙ্কট নিয়ে মতবিনিময় করেন।
আগামী নির্বাচন বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন ইউরোপীয় আইনপ্রণেতারা। একজন আইনপ্রণেতা প্রধান উপদেষ্টা ও তার সরকারের গত ১৪ মাসের ‘অসাধারণ’ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
একজন ডাচ আইনপ্রণেতা মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ স্বল্পসংখ্যক দেশের মধ্যে অন্যতম, যেখানে ‘ঘটনাগুলো সঠিক পথে এগোচ্ছে’। প্রধান উপদেষ্টা ইইউর অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য বাড়তি তহবিল দেয়ার আহ্বান জানান।
বিশেষ করে সম্প্রতি অর্থাভাবের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্কুলগুলো পুনরায় চালু করতে সহায়তা দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কারগুলো তুলে ধরে বলেন, এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক আরো জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।