পার্বত্য চট্টগ্রামে একসময় ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সবার বসতবাড়ি ছিল মাচাংঘর। পাহাড়ের ভৌগোলিক পরিবেশ-প্রতিবেশ, অধিবাসীদের জীবিকা ও পাহাড়ি ভূমির জুমচাষের সঙ্গে লাগসই অভিযোজনের স্থাপত্যে গড়ে উঠেছে মাচাংঘরের ঐতিহ্য। আবার এই ঐতিহ্য প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ধারার সাংস্কৃতিক পরিচয়কেও পরিপুষ্ট করেছে। এ জন্য একই পাহাড়ে বসবাস করেও তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনি মাচাংঘরের স্থাপত্যশৈলীতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। কিন্তু বন উজাড়, পেশার পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মাচাংঘর।
বম জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী মাচাংঘর ছবি: সংগৃহীত
ঢেউখেলানো পাহাড়ের ঢালে জুমখেত, তার পাশে ঝিরির ধার ঘেঁষে ছবির মতো কয়েকটি মাচাংঘর। বাঁশের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এমন বাসস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনধারার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ঐতিহ্যবাহী এই মাচাংয়ের বাড়ি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে পাহাড় থেকে।
পাহাড়ি মানুষের ক্রমেই জীবিকার পরিবর্তনের সঙ্গে সংস্কৃতির রূপান্তর ও বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় এখন অনেকে আর মাচাংঘরে বসবাস করেন না। যাঁরা ধরে রেখেছেন, তাঁরাও গাছ-বাঁশ ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে মাচাংঘরের স্থাপত্যশৈলীর ধরন বদলে ফেলেছেন। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই আবাসস্থল হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ
পার্বত্য চট্টগ্রামে একসময় ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সবার বসতবাড়ি ছিল মাচাংঘর। পাহাড়ের ভৌগোলিক পরিবেশ-প্রতিবেশ, অধিবাসীদের জীবিকা ও পাহাড়ি ভূমির জুমচাষের সঙ্গে লাগসই অভিযোজনের স্থাপত্যে গড়ে উঠেছে মাচাংঘরের ঐতিহ্য। আবার এই ঐতিহ্য প্রত্যেকের স্বতন্ত্রধারার সাংস্কৃতিক পরিচয়কেও পরিপুষ্ট করেছে। এ জন্য একই পাহাড়ে বসবাস করেও তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনি মাচাংঘরের স্থাপত্যশৈলীতেও রয়েছে বৈচিত্র্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজাতি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাচাংঘরের নকশা দেখে কোন জাতিগোষ্ঠীর পাড়া, তা খুব সহজে শনাক্ত করা যায়। তাই এটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কয়েক দশক ধরে মাচাংঘর কমতে শুরু করেছে। দুর্গম এলাকায় জুমচাষি ছাড়া জেলা ও উপজেলা শহরের কাছাকাছি মাচাংঘর খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রত্যন্ত এলাকায় জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল ম্রো, খুমি, বম ও খেয়াং জনগোষ্ঠীই মূলত মাচাংঘরের ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছেন। সবচেয়ে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে চাকমাদের। মাচাংঘরও ত্যাগ করেছে তারা সবচেয়ে বেশি।
ম্রো সমাজ-সংস্কৃতি গবেষক ইয়াংঙান ম্রোর মতে, খুঁটির ওপর মাটি থেকে তিন–পাঁচ ফুট উঁচুতে মাচাংঘর তৈরি করা হয়। বনের গাছের খাম্বা বা খুঁটির ওপর বাঁশের মাচাং, শণ অথবা বাঁশপাতার ছাউনি হচ্ছে স্থাপত্যের মূল কাঠামো। শুধু বাঁশ দিয়েও নির্মাণঘর বেশি দিন টেকসই হয় না। সচ্ছল পরিবারগুলো স্থায়িত্বশীল করার জন্য শুধু গাছ দিয়ে মাচাংঘর করে। তবে বৈচিত্র্যের বিষয় হলো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাচাংঘরের নকশা ভিন্ন। চাকমাদের ঘরে সিঁড়ির দিয়ে ওঠার খোলা বারান্দাকে ইজোর বলা হয়। মারমাদের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার খোলা বারান্দার পরে মূল ঘরে। এভাবে মাচাংঘরের নকশা দেখে বোঝা যায় কোন জনগোষ্ঠীর বসবাস।
প্রতিবেশ ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে উপযোগী বলে মাচাংঘরের স্থাপত্য ঐতিহ্য শত বছর ধরে চর্চা হয়ে আসছে। কিন্তু এই স্থাপত্যশিল্পের ওপর এখনো কোনো কাজ হয়নি। মাচাংঘরের নির্মাণশৈলী উপেক্ষা করে এখন সেখানে বহুতল ইমারত নির্মাণে অনুমতি চায় অনেকে। এ জন্য পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রতিবছর পাহাড়ধসে প্রাণহানি হচ্ছে
স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়া, স্থাপত্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক।
কমছে জুমচাষ, কমছে মাচাংঘর
হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের এসব মাচাংঘর ছবি: সত্যের পথে
পাহাড়ে মাচাংঘরে বসবাসের ঐতিহ্য কেন গড়ে উঠেছে, জানতে চাইলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক নু ক্রাচিং মারমা বলেন, ভূপ্রকৃতিই কোনো অঞ্চলে জীবন–জীবিকা, সংস্কৃতি ও বাসস্থানের ধরন কী হবে, নির্ধারণ করে দেয়। সমতলের মতো বাসস্থান খাড়া পাহাড়ে হবে না। তাই স্বাভাবিকভাবে পাহাড় না কেটে প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজন করে খুঁটির ওপর মাচাংঘরের বাসস্থান তৈরি করা হয়। এ ছাড়া জুমচাষ ও বনাঞ্চলের সঙ্গে মাচাংঘরের সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। স্থানান্তর পদ্ধতির জুমচাষি পরিবারগুলো মাঝেমধ্যে বাসস্থান পরিবর্তন করে। বনাঞ্চল থেকে গাছ-বাঁশ সংগ্রহ করে তাঁরা যেমন খুব সহজে মাচাংঘর নির্মাণ করে, তেমনি সেই মাচাংঘরের স্থায়িত্বকালও কম। এ জন্য যেসব এলাকায় মানুষ জুমচাষ ছেড়ে বাগান–বাগিচা করে স্থায়ী বসবাস করছে, সেখানে কম স্থায়িত্বের মাচাংঘর না করে দীর্ঘস্থায়ী টেকসই ঘরবাড়ি নির্মাণের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
জুম সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেন জিরকুং সাহু বম। তিনি জানালেন, পাহাড় ও পাহাড়ি বনাঞ্চলে জুমচাষ হয়। জুমচাষের ওপর ভিত্তি করে তাদের ঘরবাড়ি, খাদ্যাভ্যাস ও নান্দনিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মাচাংঘর জুম সংস্কৃতিরই অংশ। বর্তমানে পাহাড় আছে, নানা কারণে বনাঞ্চল ও জুমচাষ সংকুচিত হয়ে মাচাংঘরের ঐতিহ্যও টানাপোড়েনে পড়েছে। জীবিকার পরিবর্তনের সঙ্গে জুম সংস্কৃতিরও রূপান্তর ঘটছে। মাচাংঘরের পরিবর্তে মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত টেকসই পাকা, আধা পাকা টিনের ছাউনি বাড়ি করছেন। অথচ খাড়া পাহাড়ি পরিবেশে লাগসই ও টেকসই হওয়ায় পাহাড়ের মানুষ শত শত বছর ধরে মাচাংঘরে বসবাস করেছেন। মাচাংঘরের বসবাসের কোনো পাড়ায় পাহাড় ধসে কারও মৃত্যু হওয়ার কোনো নজির নেই। এই স্থাপত্যরীতি না মেনে পাহাড় কেটে করা ঘরবাড়িতে পাহাড়ধসে ২০১৭ সালে তিন পার্বত্য জেলা শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ম্রো সমাজ-সংস্কৃতি গবেষক ইয়াংঙান ম্রোর মতে, খুঁটির ওপর মাটি থেকে তিন–পাঁচ ফুট উঁচুতে মাচাংঘর তৈরি করা হয়। বনের গাছের খাম্বা বা খুঁটির ওপর বাঁশের মাচাং, শণ অথবা বাঁশপাতার ছাউনি হচ্ছে স্থাপত্যের মূল কাঠামো। শুধু বাঁশ দিয়েও নির্মাণঘর বেশি দিন টেকসই হয় না। সচ্ছল পরিবারগুলো স্থায়িত্বশীল করার জন্য শুধু গাছ দিয়ে মাচাংঘর করে। তবে বৈচিত্র্যের বিষয় হলো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাচাংঘরের নকশা ভিন্ন। চাকমাদের ঘরে সিঁড়ির দিয়ে ওঠার খোলা বারান্দাকে ইজোর বলা হয়। মারমাদের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার খোলা বারান্দার পরে মূল ঘরে। এভাবে মাচাংঘরের নকশা দেখে বোঝা যায় কোন জনগোষ্ঠীর বসবাস।
বিলুপ্তির ঝুঁকি
জেলা শহরতলির হাতিভাঙ্গা ত্রিপুরা পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র মাচাংঘর। পাড়ার সিমনচন্দ্র ত্রিপুরা জানিয়েছেন, পাড়াবাসী সবাই আগের জুমচাষের জায়গায় বাগান করেন। বনাঞ্চল না থাকায় গাছ, বাঁশ, শণ ও অন্যান্য নির্মাণ উপকরণের অভাবে পাড়াবাসী আর মাচাংঘর করেন না। বাঁশ-গাছের দাম বেশি হওয়ায় মাচাংঘরের একই খরচে পাহাড়ের মাটি সমতল মাচাংঘরের চেয়ে টেকসই ঘর করা সম্ভব।
চিম্বুক পাহাড়ে আড়াই দশক আগেও ম্রোরা সবাই জুমচাষি ছিলেন। এখন সেখান আম, কুল, ড্রাগন ফল ও সবজি বাগান ছাড়া জুমচাষ দেখা মেলে না। তবে ম্রোরা এখনো মাচাংঘরে বসবাস করেন। কিন্তু ঐতিহ্যগত মাচাংঘরের ধরন বদলে যাচ্ছে জানালেন রামরিপাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) চিংতুই ম্রো। তাঁর মতে, জুমচাষ না করলে ধান ও জুমের ফসল রাখার জন্য ঘরে জায়গার দরকার হয় না। তাই জুমচাষি না হলে মাচাংঘরও অন্য ধাঁচে করা হয়। তবে থানচি, রুমার দুর্গম এলাকার জুমচাষিরা এখনো আগের ঐতিহ্যে মাচাংঘর করেন। থানচি ও রোয়াংছড়িতে চাকমাপাড়াগুলোতে মাচাংঘর দেখা যায়নি। পাহাড়ের শিরায় ও পাহাড় ঢাল কেটে সমতলের এলাকার মতো ঘর করেছেন তাঁরা। বম, খেয়াং, খুমিরা এখনো প্রায় শতভাগ মাচাংঘরে বসবাস করে জানালেন লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। মারমা, ত্রিপুরা, চাক জনগোষ্ঠীও এখনো অধিকাংশ মাচাংঘরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে আগের স্থাপত্যশৈলী পরিবর্তন হয়েছে।
স্থাপত্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়া বলেছেন, পাহাড়ের ভৌগোলিক গঠনে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে উপযোগী বলে মাচাংঘরের স্থাপত্য ঐতিহ্য শত বছর ধরে চর্চা হয়ে আসছে। কিন্তু এই স্থাপত্যশিল্পের ওপর এখনো কোনো কাজ হয়নি। মাচাংঘরের নির্মাণশৈলী উপেক্ষা করে এখন সেখানে বহুতল ইমারত নির্মাণে অনুমতি চায় অনেকে। এ জন্য পরিবেশ বিপর্যয়ে প্রতিবছর পাহাড়ধসে প্রাণহানি হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের ওপর…