

দেশে গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ আর যেন কেউ করতে পারে, সে জন্য সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গুম কমিশনের সদস্যরা। তাঁদের আহ্বান, গুমকে চিরতরে শেষ করে গুমঘরে পাঠাতে হবে। এ জন্য যেসব ব্যক্তিদের বিরদ্ধে গুরুতর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আজ শনিবার দুপুরে বরিশাল ক্লাবের গোলাম মাওলা কনভেনশন সেন্টারে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় উঠে আসে এমন বক্তব্য।
অনুষ্ঠানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন গুম কমিশনের সদস্যরা। মতবিনিময় সভায় গুমের ঘটনার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। পরে গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা তাঁদের স্বজনদের গুম হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মতবিনিময় সভায় নিখোঁজ দুই সন্তানকে ফেরত চেয়ে আবেগপ্রবণ বক্তব্য দেন বরিশাল নগরের ফিরোজা বেগম। তিনি বলেন, ‘২০১২ সালের ৩ এপ্রিল বড় ছেলে ফিরোজ খান ওরফে কালু এবং ২০১২ সালের ২৪ আগস্ট ছোট ছেলে মিরাজ খানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। থানা থেকে শুরু করে র্যাব অফিস—সর্বত্র খুঁজেছি কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি। আমি আর কিছু চাই না, শুধু আমার সন্তানদের ফিরিয়ে দিন।’
আরেক ভুক্তভোগী পরিবারের মেয়ে হুমায়রা হুদা বলেন, ‘বাবার সঙ্গে জমিজমার বিরোধ থাকায় ২০১০ সালে বাবা নিখোঁজ হন। অনেক স্থানে খুঁজেছি, কিন্তু কোনো ফল মেলেনি।’
সভায় বক্তব্য দেন গুম কমিশনের সদস্য ও হাইকোর্টের সাবেক অতিরিক্ত বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান ও সাজ্জাদ হোসেন। গুমসংক্রান্ত উপস্থাপনা করেন তাসকিন ফাহমিনা। অধিকারের পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলান সভায় সূচনা বক্তব্য দেন। গুমের শিকার চারটি পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সভায় মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময়সভায় জানানো হয়, ২০০৯ সালে অধিকার ৭৪৫টি গুমের তথ্য সংগ্রহ করলেও বর্তমানে গুমসংক্রান্ত অভিযোগ ১ হাজার ৭০০–এর বেশি। এগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গুম কমিশন গঠন করে। কমিশনের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা অত্যন্ত গুরুতর বলে সদস্যরা উল্লেখ করেন।
গুম কমিশনের সদস্য ফরিদ আহমেদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘গুমের অপরাধ প্রায়ই পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়েছে। যাঁরা প্রমাণ সংগ্রহ করতেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে মূল আর প্রাসঙ্গিক প্রমাণ ধ্বংস করা হয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারকে ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (অদৃশ্য হওয়া বা নিখোঁজ হওয়া সনদ) প্রদানের জন্য সুপারিশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছি।’
মতবিনিময় সভায় মানবাধিকারকর্মী নূর খান উল্লেখ করেন, কেবল রাজনৈতিকভাবে বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে নয়; সাধারণ ধর্মচর্চা, বিশেষ কিছুর কারণে বা জমিজমা, স্থানীয় সংঘাত, এমনকি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেও মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘গুমকে চিরতরে শেষ করে গুমঘরে পাঠাতে হবে। এটাই আমাদের অঙ্গীকার। কোনো ধরনের গোপন বন্দিশালা বা গোপন অভিযান যাতে না থাকে, আটক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পরিবারকে জানানো বাধ্যতামূলক করা হোক এবং সাদাপোশাকে কোনো অপারেশন হলে অপারেটরদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে।’
সভায় গুম কমিশনের সদস্যরা বলেন, গুমের মতো অপরাধ দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ক্ষতি করে; এটি ব্যক্তিগত কষ্টের পাশাপাশি সমাজে ভয় সৃষ্টি করে।
সভায় অংশগ্রহণকারী মানবাধিকারকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বচ্ছতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, তথ্যের সঠিক রেকর্ড বজায় রাখা, দ্রুত আইনি পদক্ষেপ ও পার্থক্যহীন বিচার নিশ্চিত করাই এ ক্ষেত্রে জরুরি। এ সময় তাঁরা নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে যুক্ত করে মানসিক সমর্থন, আইনি সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার দাবি জানান।