কক্ষ পরিদর্শকের তালিকায় ভুয়া নাম বসিয়ে সম্মানীর টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ

রাজধানীর মগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কলেজ

রাজধানীর মগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত একটি নিয়োগ পরীক্ষায় কক্ষ পরিদর্শকের তালিকায় ভুয়া নাম ঢুকিয়ে সম্মানীর টাকা নেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কলেজের সাবেক শিক্ষক, বিদেশে অবস্থান করছেন, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন—এমন সব ব্যক্তির নাম তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। কলেজে শিক্ষকতায় আছেন, তবে পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেননি এবং ‘অচেনা’ লোকজনের নামও তালিকায় আছে।

কলেজটির একাধিক শিক্ষক সত্যের পথকে বলেন, এভাবে তালিকায় ভুয়া নাম ঢুকিয়ে সম্মানীর টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই কাজে কলেজের অধ্যক্ষ সেখ জুলহাস উদ্দিনসহ তাঁর অনুগত শিক্ষকেরা জড়িত। জুলহাস উদ্দিন কেন্দ্রসচিবের দায়িত্বে ছিলেন।

গত ৮ আগস্ট নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগের নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষার একটি কেন্দ্র ছিল সিদ্ধেশ্বরী কলেজ।

নথি অনুযায়ী, সিদ্ধেশ্বরী কলেজকেন্দ্রে নির্ধারিত পরীক্ষার্থী আসনসংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫২০। কলেজের ৩৫টি কক্ষে ১ ঘণ্টার এই পরীক্ষা হয়।

গত ৮ আগস্ট নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগের নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষার একটি কেন্দ্র ছিল সিদ্ধেশ্বরী কলেজ।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিধি অনুসারে দায়িত্ব পালনকারীদের সম্মানীসহ অন্যান্য খরচ বাবদ এই কেন্দ্রে পরীক্ষা আয়োজনে প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা (কর ছাড়া) বরাদ্দ দেয় ইসি। এর মধ্যে কক্ষ পরিদর্শকপ্রতি সম্মানী বরাদ্দ করা হয় ১ হাজার ৩৫০ টাকা। ইসিতে ১০১ জন কক্ষ পরিদর্শকের (শিক্ষক) নামের তালিকা দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কলেজটির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ইসিতে যতজন কক্ষ পরিদর্শকের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে ততজন দায়িত্ব পালন করেননি। তালিকায় থাকা কক্ষ পরিদর্শকের অন্তত ১৭টি নাম ভুয়া।

এ বিষয়ে জানতে ১৪ সেপ্টেম্বর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষ জুলহাস উদ্দিনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনিসত্যের পথকে বলেন, এমন তালিকা তাঁরা সব সময় করেন। বরাদ্দের পুরো টাকা সমন্বয় করতেই এভাবে তালিকা করা হয়। এরপর শিক্ষকেরা সেই টাকা ভাগাভাগি করে নেন।

আগে হওয়া সরকারি অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষার এমন চারটি তালিকা এই প্রতিবেদককে দেখিয়ে জুলহাস উদ্দিন বলেন, কলেজের কয়েকজন শিক্ষক বিষয়টিকে ইস্যু করছেন। নানা জায়গায় অভিযোগ দিচ্ছেন।


অধ্যক্ষ এই ভুয়া তালিকা তৈরি করেছেন, ইসির টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দায়িত্ব পালন করেননি, শিক্ষক নন-এমন অনেকের নাম তালিকায় দেখে আমি প্রতিবাদ করেছি। বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য ইসির কাছে দাবি জানিয়েছি।
—এ কে এম গিয়াসউদ্দিন, পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান

কলেজের শিক্ষক নন—এমন ব্যক্তিরা কীভাবে তালিকাভুক্ত হলেন, এমন প্রশ্নে জুলহাস উদ্দিন বলেন, সেটি তিনি জানেন না।

তালিকায় ভুয়া নাম দিয়ে সম্মানীর টাকা নেওয়ার বিষয়টি জানার পর কলেজের কয়েকজন শিক্ষক এর প্রতিবাদ করেন। তাঁরা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেন। অভিযোগে কক্ষ পরিদর্শকের পাশাপাশি সহায়ক কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অনিয়মের কথা বলা হয়।

সিদ্ধেশ্বরী কলেজের একজন শিক্ষক সত্যের পথকে বলেন, যতজন সহায়ক কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের তালিকা ইসিতে দেওয়া হয়েছে, ততজন কর্মচারী এই কলেজে নেই। এখানে অনেকগুলো ভুয়া নাম দিয়ে সম্মানীর টাকা নেওয়া হয়েছে।

সিদ্ধেশ্বরী কলেজের একজন শিক্ষক সত্যের পথে বলেন, যতজন সহায়ক কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের তালিকা ইসিতে দেওয়া হয়েছে, ততজন কর্মচারী এই কলেজে নেই। এখানে অনেকগুলো ভুয়া নাম দিয়ে সম্মানীর টাকা নেওয়া হয়েছে।

তালিকায় ভুয়া নাম

কক্ষ পরিদর্শকের নামের তালিকা ধরে অনুসন্ধান করে সত্যের পথে। এতে দেখা যায়, তালিকায় কলেজটির সাবেক শিক্ষক নাতাশা সরকার, সাবিনা মিতা, মর্জিয়া নাজনীন ও মুনিরজাদী শাহিদা আলমের নাম রয়েছে।

এই চারজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যের পথে। তাঁরা তালিকায় নিজেদের নাম থাকার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। মর্জিয়া নাজনীন বলেন, ‘আমি অনেক আগেই শিক্ষকতা থেকে অবসরে গেছি। আমার নাম সেখানে কীভাবে গেল?’


‘আমরা একটি অভিযোগে পেয়েছি। সেটি তদন্ত করে দেখছি।’
—আখতার আহমেদ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক সত্যের পথকে বলেন, কলেজটির আরও তিনজন সাবেক শিক্ষক তালিকায় আছেন।

তালিকায় নাম থাকা দুজন শিক্ষক দেশের বাইরে আছেন বলে কলেজের একাধিক শিক্ষক সত্যের পথকে নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা হলেন সমাপ্তি মৃধা ও নাজিয়া হোসেন।

কলেজের শিক্ষক সাদিয়া জামালের নাম তালিকায় রয়েছে। তবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ছিলেন। এ তথ্য নিশ্চিত করে তিনি সত্যের পথে বলেন, পরীক্ষার পর মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে তিনি কলেজে যোগ দিয়েছেন।

রাজধানীর মগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কলেজের অধ্যক্ষ সেখ জুলহাস উদ্দিন

পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন পালন না করেও কলেজটির কয়েকজন শিক্ষক তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন গোলাম মো. ফেরদৌস ভূঁইয়া ও শামসাদ আলম স্বর্ণা। তাঁরা সত্যের পথকে নিশ্চিত করেন যে পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেননি।

কলেজটির একাধিক শিক্ষক সত্যের পথকে বলেন, তালিকায় এমন দুজনের নাম আছে, যাঁদের তাঁরা চেনেন না। তাঁরা হলেন রইচ মিয়া ও কৌশিকুর রহমান টিটু। তাঁরা পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেননি।

এ বিষয়ে পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এ কে এম গিয়াসউদ্দিন সত্যের পথে বলেন, ‘অধ্যক্ষ এই ভুয়া তালিকা তৈরি করেছেন, ইসির টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দায়িত্ব পালন করেননি, শিক্ষকও নন—এমন অনেকের নাম তালিকায় দেখে আমি প্রতিবাদ করেছি। বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য ইসির কাছে দাবি জানিয়েছি।’

প্রতিবাদ করার ‘হুমকি-হয়রানি’

বিষয়টি নিয়ে জানতে ১৪ সেপ্টেম্বর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে গেলে কয়েকজন শিক্ষক এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আমিনুল ইসলাম বলেন, ভুয়া তালিকা তৈরি করে টাকা আত্মাসাতের প্রতিবাদ করার অধ্যক্ষের অনুগত কয়েকজন শিক্ষক তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। তাঁকে হয়রানি করছেন। তাঁকে নিয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

সত্যের পথের সঙ্গে কথা বলার সময় আমিনুল ইসলামের কক্ষে প্রবেশ করেন কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধির দায়িত্বে থাকা রুহুল আমিন খানসহ কয়েকজন। ভুয়া তালিকা নিয়ে কথা বলায় তাঁরা আমিনুল ইসলামকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। পরে রুহুল আমিন খান বলেন, অধ্যক্ষ জুলহাস উদ্দিনকে সরাতে কয়েকজন শিক্ষক তালিকা নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করছেন।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ সত্যের পথকে বলেন, ‘আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছি। সেটি তদন্ত করে দেখছি।’

Scroll to Top