

একসময় নানা আয়োজনে মুখর থাকত হাওরপাড়ের গ্রাম বীরগাঁও। বসত জারি-সারির আসর। তাতে গান করতেন গ্রামের বাউল মসরু পাগলা, তছকির পাগলা। বর্ষা শেষে নৌকাবাইচের আয়োজন করতেন গ্রামের তরুণ-যুবারা। দিনে দিনে এসব আয়োজনে ভাটা পড়তে থাকে। শান্তিগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁওয়ের শহীদনূর আহমদেরা ছোটবেলার সেই গ্রামকে আবার ফিরে পেতে চাইলেন। সেই ভাবনা থেকেই বছর সাতেক আগে সিদ্ধান্ত হলো, আবার তাঁরা বাইচের নৌকা বানাবেন। গ্রামের পাশের পাখিমারা হাওরে ভাসবে সেই নৌকা। মুরব্বিরাও উৎসাহ দিলেন। বীরগাঁও গ্রামের ‘খালপাড় যুব সংঘের’ উদ্যোগে চাঁদা তোলা হলো। বড়রাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। কারিগর দিয়ে একটি নৌকা বানানো হলো। খরচ হলো প্রায় সাত লাখ টাকা। গ্রামের নামের সঙ্গে মিল রেখে নৌকার নাম দেওয়া হলো ‘বীর পবন’।
এই নৌকা নিয়েই হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন নৌকাবাইচে হাজির হতে থাকলেন তরুণেরা। প্রতিটি আয়োজনে অংশ নেওয়ার আগে ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা। কারা অংশ নেবেন, কে সারি গাইবেন, কে হাল ধরবেন, বাইছালদের (মাঝি) পোশাক কী হবে, কারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন—এ রকম প্রস্তুতি চলে সপ্তাখানেক। হাওরে কয়েক দিন ধরে চলে মহড়া।

তারপর ‘এসো এসো বন্ধুগণ নাও দৌড়াইতে যাই, শ্রীবদন সারি গাইয়া বাইছালী খেলাই’—মসরু পাগলার গানের তালে তালে, কখনোবা বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়’ গাইতে গাইতে হাওরে ঢেউ তুলে মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ছোটে ‘বীর পবন’। বাইছালদের মুখে মুখে ‘শাবাশ শাবাশ, হেঁইয়ো’ জোশে সামনে এগোয় ‘ময়ূরপঙ্খি’। সেই জোশের তালে জোরসে বাইছালদের উৎসাহ দেন হাওরপাড়ের হাজারো দর্শক। কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতে বীর পবন, কোনোটাতে খালি হাতেই ফেরেন মাঝিরা। তারপরও আনন্দের কোনো কমতি তাঁদের থাকে না।
বীর পবনের পর গ্রামের অবস্থাপন্ন যুবক সাদিকুর রহমান নিজের উদ্যোগে তৈরি করেন ‘বীর বাংলা’। আলী হাসান বানান ‘রহিম শাহ তরী’। বীর পবন, বীর বাংলা, রহিম শাহ তরী নিয়ে নিজেরাই এখন গ্রামের পাশের হাওরে বাইচের আয়োজন করে তারা। নিজেরাই নৌকায় নৌকায় ভাগ হয়ে প্রতিযোগিতা করে। পাশাপাশি হাওরের যেখানেই বাইচ হয়, সেখানেই তিন নৌকা নিয়ে ছুটে যান যুবকেরা। শহীদনূর বলেন, ‘এখন তো যুবক, তরুণেরা নানা অপকাজে সময় কাটায়, কিন্তু বীরগাঁওয়ের যুবক-তরুণেরা এসবে নেই, তারা নিজেদের কাজ শেষে বীর পবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি।’
কোনো কমিটি নেই
বীর পবনের মাধ্যমে আরও নানা সামাজিক উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে ‘খালপাড় যুব সংঘ’। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আয়োজনসহ গ্রামের মানুষের নানা সমস্যা-সংকটে তাঁরা এগিয়ে যান। ভূমিকা রাখেন এলাকায় উন্নয়নে। সামাজিক আয়োজনে সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকে। সংগঠনের কোনো কমিটি কিংবা কারও কোনো পদ-পদবি নেই। বীরগাঁওয়ের আলী হাসান, শরিফুল ইসলাম, মোহাম্মদ রিফান, মিসবাহুর রহমানসহ কয়েকজন নেতৃত্ব দিলেও পাশে থাকেন সবাই। নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে এগিয়ে আসেন মুরব্বিরা।
সামাজিক নানা উদ্যোগে ব্যস্ত থাকলেও তাঁদের সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে বীর পবন। প্রতিবছর এই নৌকার সংস্কার করতে হয়। সংগঠনের উদ্যোগে মিলেমিশে সেটি করেন তাঁরা। তাই ‘বীর পবন’ এখন শুধু একটি নৌকার নাম নয়, বীরগাঁওয়ের মানুষের একাত্মতার প্রতীক, সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।