জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে অসুবিধা দেখছে না বিএনপি। এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছে দলটি। এ ব্যাপারে নির্বাচিত সংসদ গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে। গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের নীতি-নির্ধারকরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। বৈঠকে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সভাপতিত্ব করেন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। এ বিষয়টি নিয়েও বিএনপির বৈঠকে আলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটি মনে করে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিতে পৃথকভাবে গণভোট আয়োজনের
অসুবিধা রয়েছে। সেটি হলো, আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল আয়োজনের জন্য দেশকে প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচনকে বিলম্বিত করা এর একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। একই দিনে দুটি ব্যালট দিলে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে বলে অনেকের যে ধারণা, সেটির সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “একই দিনে দুটি ব্যালট দিলে অসুবিধা হবে- এটা কী রকম প্রশ্ন আমি বুঝলাম না। এখন তো আমরা তিনটি ব্যালটে ভোট দিতে অভ্যস্ত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে চেয়ারম্যান, মহিলা মেম্বার ও পুরুষ মেম্বারের জন্য ভোট দিচ্ছি না? উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান ভোট দিচ্ছি না? একইভাবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর তিনটি ব্যালটে ভোট দেওয়া হয়। সুতরাং আমাদের জনগণ প্রস্তুত। গণভোট যে ব্যালটে হবে, সাধারণ জনগণকে বোঝাতে নির্বাচন কমিশন প্রচারণা চালাতে পারে। লাল চিহ্নের মধ্যে টিক দিলে ‘না’, গ্রিন চিহ্নের মধ্যে টিক দিলে ‘হ্যাঁ’Ñ এ রকম নমুনা হতে পারে।”
বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ বৈঠকের আলোচনার সারাংশ স্থায়ী কমিটিকে অবহিত করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এরপর স্থায়ী কমিটিতে সেটি নিয়ে বিশেষ করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনে একই সঙ্গে গণভোট নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, গণভোটের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। রেফারেন্ডামের (গণভোট) আর্টিকেল ১৪২ ফ্যাসিস্ট সরকার উড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে প্রতিস্থাপন হয়েছে। ফলে সংবিধান বা অন্যান্য জাতীয় ইস্যুতে গণভোট করা যাবে না, এমন কোনো বিধান নেই।
বিএনপি মনে করে, গণভোট একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণ সরাসরি মতামত দেয়। সংসদ বা সরকারের পরিবর্তে জনগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত ওই গণভোটের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচিতে আস্থা রাখেন?’ ভোটারদের জন্য দুটি বিকল্প ছিলÑ ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’।
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। সেই সময় ক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা প্রদর্শন।
১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে একটি ‘সাংবিধানিক’ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?
শেখ হাসিনার শাসনামলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ?্যমে সংবিধানে ব?্যাপক পরিবর্তন করা হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ?্যমে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৫৬ এবং ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে গণভোটের বিধান ছিল। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে অন?্যান?্য বিষয়ের মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাদ দেওয়া ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনরায় বহাল করার কথা বলা হয়। বিএনপিপন্থি একজন আইনজীবী মনে করেন, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে আদালতের রায়ের পর সেই রায়ের আলোকে সংসদ কর্তৃক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার নজির রয়েছে। বর্তমানে যেহেতু সংসদ বহাল নেই, কাজেই সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব নয়। সংবিধান সংশোধন করতে হলে পরবর্তী সংসদকেই সেটা করতে হবে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বিচার-বিশ্লেষণ করে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন নেতারা। বিভিন্ন প্রশ্নের ‘নায়কোচিত’ জবাব দেওয়ায় টেবিল চাপড়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান তাঁরা।
দীর্ঘ ১৭ বছরের জমা নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তারেক রহমান। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর বক্তব্যের ইতিবাচক দিক তুলে ধরে নানা মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। ছিল না প্রতিহিংসামূলক কোনো বক্তব্য। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য ছিল প্রশংসনীয়। ভারত ও আওয়ামী লীগ বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তারেক রহমান। মেয়ের বিড়াল, প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা, বৃক্ষরোপণ, আবহাওয়া ইত্যাদি নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সংস্কার নিয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকার অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী বলে মনে করেন স্থায়ী কমিটির নেতারা। যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার দেশি-বিদেশি যাঁরাই শুনেছেন বা পড়েছেন, আমার মনে হয় সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পর বাংলাদেশের পরবর্তী নেতা তারেক রহমান, তা তিনি প্রমাণ করেছেন।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে ঐক্যের বাংলাদেশÑ সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যে তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকার দলের নেতাকর্মীদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা। এই অনুযায়ী সবাইকে বক্তব্য, বিবৃতি এবং টকশোতে বলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দলের টকশো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়ে এনসিপি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলটির মুখ্য সংগঠন (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘তিনি বলেছেন, যেই ভাইকে দেশে রেখে গিয়েছিলেন, তাঁকে আর দেখতে পাবেন না। তাঁর যে ঘরে সারা জীবনের স্মৃতি, সেই ঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলোয় আমাদের সহমর্মিতা থাকবে। আগামীর বাংলাদেশে আমরা আর এ ধরনের ঘটনা প্রত্যাশা করি না। বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে এমন ঘটানো হয়েছে। এগুলো আওয়ামী লীগ করেছে। সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দোসরদের অর্থের বিনিময়ে অথবা কোনো সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে যেন আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া না হয়, আমরা সেটাও দেখতে চাই।’
এই অবস্থায় দলীয় বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে, দলের কে কোন আসনে একক প্রার্থী হিসেবে সবুজ সংকেত পাচ্ছেন। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক নেতা জানিয়েছেন, মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই দেখভাল করছেন। ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটি তাঁর ওপর এই দায়িত্ব দিয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে তিনিই প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবেন। সেই কাজ চলছে।
বৈঠকে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রস্তুতি এবং প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খুব শিগগিরই সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে অধিকাংশ আসনে একক প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে।