উত্তর কোরিয়ার জনগণ গত এক দশক ধরে যেটি আশা করেছিলেন, এসব অভিজ্ঞতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
বর্তমান নেতা কিম জং উন ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর পালিয়ে আসা ব্যক্তিরা জানান, তারা আশা করেছিলেন তাদের জীবনমান উন্নত হবে। কিম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আর তাদের “পেট চেপে” বাঁচতে হবে না—অর্থাৎ খাবারের অভাব থাকবে না। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তা জোরদার করবেন পারমাণবিক অস্ত্র আরও উন্নয়নের মাধ্যমে।
কিন্তু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে কিম পশ্চিমা দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনীতি এড়িয়ে গিয়ে অস্ত্র কর্মসূচির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার পর থেকে মানুষের জীবনযাত্রা ও মানবাধিকারের অবস্থা আরও “অবনতিশীল” হয়েছে।
সাক্ষাৎকার দেওয়া প্রায় সবাই বলেছেন, তাদের পর্যাপ্ত খাবার নেই, আর দিনে তিনবেলা খাওয়া যেন একধরনের “বিলাসিতা”। কোভিড মহামারির সময় অনেকেই জানান, দেশে তীব্র খাদ্য সংকট ছিল এবং অনেকে অনাহারে মারা যান।
একই সময়ে সরকার পরিবারগুলো যে অনানুষ্ঠানিক বাজারে পণ্য বেচাকেনা করে জীবিকা নির্বাহ করত, সেখানে কঠোর দমন চালায়, যা তাদের জন্য আয় রোজগার করা আরও কঠিন করে তোলে। পাশাপাশি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব করে তোলে সরকার—চীনের সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয় এবং সীমান্ত পার হতে চেষ্টা করলে সৈন্যদের গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
“কিম জং উনের শুরুর দিনে আমাদের কিছুটা আশা ছিল, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি,” বললেন এক তরুণী, যিনি ২০১৮ সালে ১৭ বছর বয়সে পালিয়ে আসেন।
“সরকার ধীরে ধীরে মানুষকে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করার পথ রুদ্ধ করেছে, আর বেঁচে থাকার সাধারণ কাজটিই প্রতিদিনের এক নিদারুণ যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল,” গবেষকদের কাছে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “গত ১০ বছরে সরকার মানুষের ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, ফলে তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক—কোনো সিদ্ধান্তই নিজেরা নিতে পারছে না।” প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নজরদারি প্রযুক্তির উন্নতি এ কাজে সহায়তা করেছে।
এক পালিয়ে আসা ব্যক্তি গবেষকদের জানান, এসব সরকারি দমনমূলক পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল “মানুষের চোখ-কান বন্ধ করে দেওয়া।”
“এটি একধরনের নিয়ন্ত্রণ, যার উদ্দেশ্য হলো ক্ষুদ্রতম অসন্তোষ বা অভিযোগের চিহ্নও মুছে ফেলা,” তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন।
[caption id="attachment_3497" align="alignnone" width="779"] মানুষ মোজাইকের সামনে মাথা নত করছে[/caption]
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এক দশক আগের তুলনায় সরকার এখন আরও বেশি জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার করছে। দরিদ্র পরিবারের মানুষদের “শক ব্রিগেডে” নিয়োগ দেওয়া হয়, যেখানে তাদের কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়—যেমন নির্মাণকাজ বা খনির প্রকল্পে।
শ্রমিকরা আশা করেন, এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে। কিন্তু এই কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, আর মৃত্যুও সাধারণ ঘটনা। শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়ানোর পরিবর্তে সরকার এসব মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরে, কিম জং উনের জন্য “আত্মত্যাগ” হিসেবে ঘোষণা দেয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার হাজার হাজার অনাথ ও পথশিশুকেও এ কাজে নিয়োগ দিয়েছে।
এই সর্বশেষ গবেষণা ২০১৪ সালের জাতিসংঘ কমিশনের যুগান্তকারী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরবর্তী ধাপ। সেই প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো উঠে আসে, উত্তর কোরিয়ার সরকার মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। দেশের কুখ্যাত রাজনৈতিক কারাগার শিবিরগুলোতেই সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলে জানা যায়—যেখানে মানুষকে আজীবনের জন্য বন্দী রাখা হয় এবং “গায়েব” করে দেওয়া হয়।
২০২৫ সালের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত চারটি কারাগার শিবির এখনও চালু রয়েছে। একইসঙ্গে, সাধারণ কারাগারেও বন্দীদের ওপর নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার চলছে।
অনেক পালিয়ে আসা ব্যক্তি জানান, তারা বন্দীদের অমানবিক আচরণ, অতিরিক্ত শ্রম ও অপুষ্টির কারণে মারা যেতে দেখেছেন। তবে জাতিসংঘ কিছু “সীমিত উন্নতির” কথাও শুনেছে—যার মধ্যে রয়েছে “প্রহরীদের দ্বারা সহিংসতা সামান্য কমে আসা”।
[caption id="attachment_3498" align="alignnone" width="600"] —পুতিন, চীনের শি, কিম[/caption]
জাতিসংঘ হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে এই পরিস্থিতি পাঠানোর আহ্বান জানাচ্ছে।
তবে এটি ঘটার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে রেফার করা প্রয়োজন। ২০১৯ সালের পর থেকে এর দুই স্থায়ী সদস্য, চীন ও রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রচেষ্টাকে বারবার ব্লক করেছে।
গত সপ্তাহে কিম জং উন চীনা নেতা শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বেইজিংয়ে একটি সামরিক প্রদর্শনীতে যোগ দেন, যা এই দেশগুলোর নীরবভাবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি এবং নাগরিকদের প্রতি আচরণের প্রতি অনুমোদনের ইঙ্গিত দেয়।
জাতিসংঘ কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে না, বরং উত্তর কোরিয়ার সরকারকে অনুরোধ করছে—রাজনৈতিক কারাগার শিবিরগুলো বাতিল করতে, মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার বন্ধ করতে এবং নাগরিকদের মানবাধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দিতে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মি. তুর্ক বলেন, “আমাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, পরিবর্তনের প্রতি একটি শক্তিশালী আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, বিশেষ করে (উত্তর কোরিয়ার) তরুণদের মধ্যে।”