

নাচে দক্ষ বা পারদর্শী বিভিন্ন মাকড়সার ডিএনএ-র রহস্যেই হয়ত লুকিয়ে আছে এরা নতুন প্রজাতিতে রূপ নেয়– এমনই বলছেন গবেষকরা।
অস্ট্রেলিয়ার নাচে পারদর্শী বিভিন্ন মাকড়সার ঝলমলে রং আর চটপটে নড়াচড়াই কেবল এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এ পিকক বা ময়ূর প্রজাতির মাকড়সার রয়েছে একশটিরও বেশি প্রজাতি, যেখানে অধিকাংশ প্রাণীর বেলায় থাকে কেবল পাঁচ-দশটি প্রজাতি।
গবেষকরা বলছেন, এর পেছনে একটি কারণ হল মাকড়সার ‘ডার্ক ডিএনএ’, যা প্রাণীর জেনেটিক কোডের একটি রহস্যময় অংশ। এ অংশটি নিয়ে আরও জানার চেষ্টা করছেন তারা।
তাদের ধারণা, এ ‘ডার্ক ডিএনএ’ একটি মাকড়সাকে নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে দ্রুত পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিক জগতে কেন এত বৈচিত্র্য তা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করতে পারে তাদের এ গবেষণা।
“কীভাবে এসব মাকড়সা এত বৈচিত্র্য নিয়ে বিবর্তিত হয় তা জানতে আমরা আগ্রহী,” বলেছেন ‘স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউট’-এর জোনাহ ওয়াকার।
“আপনি যখন বাইরে যান তখন গাছপালা ও প্রাণীদের প্রজাতির মধ্যে নানা ধরনের বৈচিত্র্য দেখতে পান। পিকক মাকড়সাগুলো সেই বৈচিত্র্যের চরম উদাহরণ। ফলে এদের নিয়ে গবেষণা করে আমরা এই চরম উদাহরণকে ব্যবহার করে বোঝার চেষ্টা করতে পারি– সাধারণভাবে প্রকৃতিতে কীভাবে বৈচিত্র্য তৈরি হয়।”
অস্ট্রেলিয়াজুড়েই পিকক মাকড়সা পাওয়া যায় এবং প্রতিটি মাকড়সার আকার একটি পিনের মাথার মতো ছোট। এদের ‘পিকক মাকড়সা’ বলার কারণ হচ্ছে, এদের পুরুষ মাকড়সার পেটের অংশে চমৎকার উজ্জ্বল রং থাকে, যা এরা প্রজনন নাচের সময় সঙ্গীকে দেখায়।
বিবিসি লিখেছে, এ সময় এরা নিজেদের পা দিয়ে ঢাক ঢাক শব্দ তৈরি করে, যা এক ধরনের মাকড়সার গান ও ছন্দময় নাচে এদের ঝলমলে নকশাওয়ালা বিভিন্ন অংশ প্রদর্শন করে। এদের সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে এদের চেহারা, গান ও নাচের চলনে কতটা বৈচিত্র্য রয়েছে সেটি।
আগে মাকড়সা দেখে ভয় পেলেও নিজের এই ভয় জয় করেছেন ওয়াকার। কারণ তিনি মাকড়সার পেছনের বিজ্ঞানকে খুব আকর্ষণীয় বলে মনে করেন এবং এই প্রকল্পটি নিজের পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে নিয়েছেন তিনি।
“আমি যখন বন্ধু ও পরিবারকে বললাম, আমি অস্ট্রেলিয়ায় মাকড়সা নিয়ে গবেষণা করতে যাচ্ছি তখন তাদেরকে কিছুটা বিচলিত দেখালো এবং আমি নিজেও একটু ভীত ছিলাম। তবে কেবল কয়েক সেকেন্ড মাকড়সার নাচ দেখলেই আমার সব ভয় মুছে গেল।”
তার এ গবেষণা দলটির নেতৃত্বে থাকা ডা. জোয়ানা মেয়ার ও একটি আন্তর্জাতিক দলের সঙ্গে মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রতিটি মাকড়সার প্রজাতি সংগ্রহ করেছেন ওয়াকার।
এরপর তারা খুব যত্নসহকারে প্রতিটি প্রজাতির আচরণ, চলাচল ও গান সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন তথ্য প্রতিটি প্রজাতির ডিএনএ-এর সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করাই ছিল পুরো গবেষণার শেষ ধাপ।
প্রতিটি প্রজাতির ফলাফল তুলনা করে গবেষকরা জানতে পেরেছেন কোন কোন জিন এদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী এবং শেষ পর্যন্ত কেন পিকক মাকড়সার এত ভিন্ন ধরনের প্রজাতি রয়েছে।
গবেষণাটি এখনও চলছে। তবে, দলটির কাছে এরইমধ্যে আরও গবেষণার জন্য জোরালো বৈজ্ঞানিক সূত্র রয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
ওয়াকার বলেছেন, “গবেষণাটি চললেও আমাদের আবিষ্কারের রোমাঞ্চকর বিষয় হল বৈচিত্র্যের জন্য কেবল বিভিন্ন জিন দায়ী না-ও হতে পারে, বরং জিনের মধ্যে থাকা বিভিন্ন অংশ, যাকে ‘ডার্ক ডিএনএ’ বলা হচ্ছে এটিও এসব মাকড়সার বিবর্তনে প্রভাব ফেলতে পারে।”
ডিএনএ হল বিভিন্ন অণুর লম্বা চেইন বা শৃঙ্খল। এর কিছু অংশ নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে কাজ করে। মানুষের ক্ষেত্রে, এগুলো উচ্চতা বা চোখের রং নির্ধারণ করতে পারে। এসব অংশকে জিন বলা হয়।
তবে ডিএনএ-এর বেশিরভাগ অংশ জিন নয়, এবং এখনো কেউ ঠিক জানে না এগুলো কী কাজ করে। ‘স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউট’-এর গবেষকদের অনুমান, এই প্রচলিত ‘ডার্ক ডিএনএ’ পিকক মাকড়সার বৈচিত্র্যের জন্য দায়ী হতে পারে।
পিকক মাকড়সাদের ‘ডার্ক ডিএনএ’ মানুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি। ‘আর্থ বায়োজিনোম প্রজেক্ট’-এর অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত তিন হাজারটি ভিন্ন প্রজাতির ডিএনএ ডিকোড করেছেন গবেষকরা।
তাদের লক্ষ্য, আগামী বছরে ১০ হাজার প্রজাতির ডিএনএ ডিকোড করা ও আগামী দশকে মোট ১৮ লাখ জীবিত প্রজাতিকে সম্পূর্ণরূপে ডিকোড করা।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, এ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবজগতের বিবর্তন এবং বিভিন্ন জীবের মধ্যে যে জটিল আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে তা বোঝার সুযোগ পাবেন তারা।