

বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান মায়ানমার সফল হলেও কার্যকর উদ্যোগ নেই বাংলাদেশের। দেড় দশক ধরে ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। সমুদ্রসীমা বিজয়ের এক যুগের বেশি সময় পরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস আবিষ্কার করা যায়নি।
তবে চীনের সহযোগিতায় আরব সাগরের তলদেশে যৌথ সমীক্ষা চালিয়ে সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করেছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের আগে গত বছরের জানুয়ারিতে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালিয়ে বড় সাফল্যের কথা জানায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে গভীর সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী খনির কার্যক্রম শেষ হলে প্রতিদিন গড়ে ৪৫ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।
এছাড়া সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১২ সালের মার্চে। জরিপ ও অনুসন্ধান শেষ করে বিরোধ নিষ্পত্তির পরের বছরেই বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করে প্রতিবেশী দেশটি।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, গত বছর ১০ মার্চ সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিল পেট্রোবাংলা। একই সঙ্গে দরপত্রে অংশ নিতে বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের ৫৫টি কম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। দরপত্র জমার সময় ছিল ছয় মাস, সেটি গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। সেখানে ৭টি বিদেশি কম্পানি দরপত্রের নথি কিনেছিল শুরুতে। দরপত্রপ্রক্রিয়া আরো প্রতিযোগিতামূলক করতে সময় বাড়ানো হয় তিন মাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বিদেশি কম্পানি দরপত্র জমা দেয়নি। এখন নতুন করে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লকসহ ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে দুটি ব্লকে কাজ নেয় কনোকোফিলিপস। দ্বিমাত্রিক জরিপ চালালেও পরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায় তারা। একইভাবে চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। এখন একমাত্র কম্পানি হিসেবে অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে ভারতের কম্পানি ওএনজিসি। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আশাব্যঞ্জক কোনো খবর জানাতে পারেনি। সম্প্রতি কম্পানি দুটির পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা। ফলে বাংলাদেশের জলসীমায় জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বর্তমানে আর কোনো কম্পানির কার্যক্রম নেই।
বঙ্গোপসাগরে প্রাথমিক সম্ভাবনা যাচাই করতে জার্মানির কম্পানি স্লামবার্জারকে দিয়ে বহুমাত্রিক জরিপ চালানো হয়েছে। এ ছাড়া কনোকোফিলিপসের পরিচালিত দ্বিমাত্রিক জরিপের তথ্যও আছে পেট্রোবাংলার কাছে। এতেও গ্যাসের সম্ভাবনা দেখা গেছে বঙ্গোপসাগরে। যদিও অনুসন্ধান কূপ খনন ছাড়া উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করা যায় না। এখন পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে কোনো কূপ খনন করা হয়নি। তবে একই সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে পাশের দুই দেশ ভারত ও মায়ানমার।
সূত্র বলছে, সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট ও মেরিন জেনেটিক রিসোর্সের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৪ সালের মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তির ফলে এখন এই অপারসম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ।
ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম বলেন, বহুজাতিক কোম্পানি সারা বিশ্বে বিনিয়োগ করে। তারা যখন বঙ্গোপসাগর নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সরকার উদ্যোগ নেয়নি। যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, তত দিনে তারা হয়তো অন্য দেশে বিনিয়োগে দৃষ্টি দিয়েছে। সমুদ্রে একটা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলেই বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ–আগ্রহ বেড়ে যাবে। তাই দ্রুত দরপত্র আহ্বান করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা উচিত।এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব বলেন,
“সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ডাকা দরপত্রে কেন কোনো কম্পানি অংশ নেয়নি, সে বিষয়গুলো রিভিউ করে আমরা জ্বালানি বিভাগে প্রতিবেদন দিয়েছি। সুনির্দিষ্টভাবে সেখানে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই ও মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত দিলে আমরা দরপত্রে যাব। হয়তো এ বছরের মধ্যেই অফশোরে এ দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হবে।”
এ বিষযে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, অফশোরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। বিদেশী বিভিন্ন কম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করা হয়েছে, কেন তারা দরপত্রে অংশ নেয়নি। তাতে কম্পানিগুলো তেল-গ্যাস উত্তোলনে কোম্পানির প্রফিট শেয়ার মার্জিন, জরিপের তথ্য-উপাত্তে ঘাটতি এবং তেল-গ্যাস কোম্পানির কর্মীদের প্রফিট ফান্ডের (ডব্লিউপিপিএফ) শেয়ারিং বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এগুলো কতটুকু সংশোধন-পরিমার্জন করা যায়, তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। খুব দ্রুতই এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পুনরায় দরপত্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হবে।
