

জন্ম থেকেই দুই পা বিকল, এক হাতে চার আঙুল আর অন্য হাতে দুটি আঙুল—এমন শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছেন মফিজ উদ্দিন (৬১)। তবে কখনো হাল ছাড়েননি, ভিক্ষা করেননি, অন্যের কাছে হাত পাতেননি। নিজের শ্রমেই সংসার চালিয়ে এসেছেন তিনি। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও তিনি হাল ছাড়েননি।
মফিজ উদ্দিনের বাড়ি নড়াইল শহরের দুর্গাপুর এলাকায়। নড়াইল-মাগুরা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে রেলসেতুর নিচে তাঁর অস্থায়ী দোকান। মাদুর পেতে বেচাকেনা করেন তিনি।
গতকাল শনিবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মফিজ উদ্দিনের দোকানে আছে বিস্কুট, চানাচুর, বাদাম, সিগারেট, শিশুদের জন্য টফি ও চিপস। পণ্যের পরিমাণ বেশি নয়। চলতি পথের ক্রেতারা মাঝেমধ্যে থেমে সামান্য কেনাকাটা করছেন।
সত্যের পথের সঙ্গে আলাপে মফিজ জানান, তিনি জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যও প্রতিবন্ধী। তবে তাঁরা সবাই কর্ম করেই জীবন চালান। মফিজের কোনো জায়গাজমি না থাকায় দোকানের পাশে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। সঙ্গে থাকে তাঁর ছোট মেয়ে। মেয়েটি এবার নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। অন্য দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগেই।
প্রতিবন্ধিতাকে কখনোই বেঁচে থাকাতে বাধা মনে করেননি জানিয়ে মফিজ বলেন, ‘শারীরের এ অবস্থার কারণে তেমন কঠিন কোনো কাজ করতি পারি না। তবে বইসেও থাকিনি। যুব উন্নয়নের সামনে আমার এট্টা ছোট মুদিদোকান ছিল। প্রায় ২৫ বছরের মতো ওখানে দোকানদারি করিছি। বেশ কয়েক বছর আগে দোকানডা নষ্ট হইয়ে ভাইঙ্গেচুরে যায়। টাকার অভাবে আর দোকানঘর করতি পারিনি। এরপর কিছু সময় বেকার বইসে ছিলাম। সংসার তো আর চলে না। বছর চারেক আগে আবার এখানে কিছু মালামাল নিয়ে মাদুর পাইতে বইছি।’
জীবনের প্রতি তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। মফিজ বলেন, ‘হয়তো অর্থসম্পদ থাকলি বাড়িঘর করে ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে থাকতি পারতাম। কিন্তু তা তো নাই ৷ দুই-চার হাজার পুঁজি আছে, তাই দিয়ে বেচাকিনা করি। কোনরহম খায়ে না খায়ে চলতি হয়। তারপরও বলব, ওপর আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো আছি। যদি দোকানঘর তুলতে পারতাম, আর মালামাল উঠাতে পারতাম, তালি বেইচেকিনে আরেকটু ভালো থাকতি পারতাম।’
দীর্ঘ সময় মফিজের পাশে বসে থাকতে দেখা যায় তাঁর বন্ধু লুৎফার মোল্লাকে। তিনি বলেন, ‘মফিজ ছোটবেলা থেকেই কাজকর্ম করে। আয় হলি খায়, না হলি না খায়। কিন্তু কারও দুয়ারে যায় না।’
মফিজ উদ্দিন, নড়াইল শহরের দুর্গাপুর এলাকার বাসিন্দা
দুর্গাপুর এলাকার বাসিন্দা কাজী আরাফাত, ইমন সিকদার, পথচারী সবা আলী খান, রবিউল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, মফিজ ভিক্ষা না করে পরিশ্রম করে সংসার চালান। সরকার ও বিত্তবানদের উচিত তাঁকে একটি দোকানঘর ও মূলধন দিয়ে সহায়তা করা। এতে তিনি আত্মসম্মানের সঙ্গে আরও ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারবেন।
নড়াইল শহরের সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সুজা উদ্দীন সত্যের পথকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হয়েও মফিজ উদ্দিন পরিশ্রম করে সংসার চালান, এটি প্রশংসনীয়। তাঁকে আমরা প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দিয়েছি। সুদমুক্ত ঋণসহ সরকারি সহযোগিতার যেকোনো সুযোগ থাকলে দেওয়া হবে, যাতে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারেন।’