

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পাওয়া অনেক তরুণের স্বপ্ন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত ফলাফলে নাম আসা সেই স্বপ্নের সিঁড়ি। কিন্তু চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েও মাসের পর মাস যদি নিয়োগ আটকে থাকে, তা হয় যেন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’। এমন অবস্থার মধ্যে আছেন পেট্রোবাংলার কারিগরি ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া ৩২৭ প্রার্থী। ৩২৭ পদের মধ্য ফেরিফিকেশনের জন্য আবেদন করেন ২৯১ জন।
চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও চাকরিতে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি দেশের বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা।
একটি সরকারি নিয়োগের পথচলা
পেট্রোবাংলা ২০২৪ সালের ৫ মার্চ কারিগরি, সাধারণ ও অর্থ ক্যাডারে মোট ৬৭০টি পদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। একই বছরের ৩১ মে অনুষ্ঠিত হয় কারিগরি ক্যাডারের লিখিত পরীক্ষা। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় চূড়ান্ত ফলাফল। এর মধ্যে ২৯১টি পদের পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়েছে। সাধারণত চূড়ান্ত ফলাফলের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রার্থীদের যোগদানের সুযোগ হয়। কিন্তু ফলাফল প্রকাশের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কাজে যোগদান করতে পারেননি চাকরিপ্রার্থীরা। ফলে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
চাকরি ছেড়ে বেকার
প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১০ জন আগের চাকরি ছেড়ে এখন বেকার অবস্থায় আছেন। একজন প্রার্থী আগে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি সত্যের পথেকে বলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ হবে ভেবেছিলাম। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কিছু হয়নি। সামাজিক চাপ তো আছেই, আর্থিক চাপের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।’
অন্য এক প্রার্থী বলেন, ‘বাবা অবসরে গেছেন, সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। ছোট চাকরি করতাম, সংসার চলত কোনোমতে। পেট্রোবাংলায় চাকরি হওয়ার খবর শোনার পর মা–বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। এখন তাঁদের চোখে হতাশা। পরিবার চালানোই কঠিন হয়ে গেছে।’
মানসিক চাপে প্রার্থীরা
প্রার্থীরা বলছেন, এই অনিশ্চয়তা শুধু আর্থিক নয়, মানসিক দিক থেকেও বড় চাপ তৈরি করছে। কেউ পরিবারকে ভরসা দিতে পারছেন না, কেউ আবার আত্মীয়স্বজনের কটূক্তি সহ্য করছেন।
এক প্রার্থী বলেন, ‘গ্রামে গেলে সবাই প্রশ্ন করে, কবে যোগদান করব। আমি নিজেও জানি না। লজ্জায় কথা বলতে ইচ্ছা করে না।’ আরেকজন যোগ করেন, ‘এত কষ্ট করে পরীক্ষায় পাস করেছি। এখন মনে হচ্ছে, এই অপেক্ষার চেয়ে বরং পাস না করাই ভালো ছিল।’
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
পেট্রোবাংলার নিয়োগ বিধিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের উল্লেখ নেই। কিন্তু এবার ফরম জমা নেওয়া হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে। মার্চে ভেরিফিকেশনের জন্য চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
প্রার্থীরা বলছেন, ভেরিফিকেশনে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই নিয়োগ আটকে আছে। কারিগরি ক্যাডারের ভেরিফিকেশন শেষ হলেও সাধারণ ও অর্থ ক্যাডারের প্রক্রিয়া এখনো চলমান।
ভুক্তভোগীরা দাবি করছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই এই দেরি হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার ব্যাখ্যা
পেট্রোবাংলার পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এস এম মাহবুব আলম সত্যের পথেকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নন–ক্যাডার নিয়োগের বিধি অনুযায়ী একই বিজ্ঞপ্তির সব ক্যাডারের নিয়োগ একসঙ্গে দিতে হবে। কারিগরি ক্যাডারের ভেরিফিকেশন শেষ হলেও অন্য দুটি শেষ হয়নি। আমরা নিয়মিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত শেষ করতে বলছি। নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
প্রার্থীদের দাবি
ভুক্তভোগীরা বলছেন, দ্রুত নিয়োগ না হলে তাঁদের অনেকেই নতুন করে চাকরির চেষ্টা শুরু করতে বাধ্য হবেন। তাতে সময় ও সুযোগ নষ্ট হবে। একজন প্রার্থী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ আটকে আছে। যত দেরি হচ্ছে, ততই বয়স বাড়ছে। সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা তো আছে। এভাবে সময় চলে গেলে নতুন করে চেষ্টা করার সুযোগও কমে যাবে।’
প্রার্থীরা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত ফলাফলে নাম আসার পর তাঁদের পরিবারের স্বপ্নও বড় হয়েছে। এখন সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার শঙ্কায় সবাই দিশাহারা।
একজন বলেন, ‘আমরা চাই না আর কোনো প্রজন্ম এমন ভোগান্তির শিকার হোক। লিখিত থেকে চূড়ান্ত ফল—সব জায়গায় পাস করেছি। এখন শুধু যোগদানের অপেক্ষা। এত কিছুর পরও যদি চাকরিটা না হয়, তাহলে আমরা কার কাছে যাব?’