
সুনামগঞ্জে গত দুই বছরে মাঝারি ও স্বল্পমাত্রার পাঁচটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। স্বল্পমাত্রার এই কম্পনগুলো অদৃশ্যভাবে হলেও ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়ানোর সতর্ক সংকেত হিসেবে ধরা হচ্ছে। জেলার উৎপত্তিস্থলগুলো মূলত ডাউকি ফল্টের ওপর অবস্থিত, যা বাংলাদেশে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ফল্টগুলোর একটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ফল্ট লাইনে শতবর্ষ ধরে সঞ্চিত শক্তি জমে আছে, যা একটি বড় ভূমিকম্পের সতর্ক সংকেত। অতীতের বড় ভূমিকম্প, যেমন ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়া আর্থকোয়েক, সুনামগঞ্জসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বর্তমান সময়ে শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো, নরম মাটি এবং সচেতনতার ঘাটতি এই ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে সিলেট অঞ্চলে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সুনামগঞ্জের ছাতকে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছাতকের অবস্থান ডাউকি ফল্ট অঞ্চলে। ডাউকি ফল্ট বাংলাদেশের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তাই স্বল্পমাত্রার ঘনঘন এ ভূমিকম্প সতর্ক সংকেত হতে পারে। গত দুই বছরে পাঁচটি স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল এই সুনামগঞ্জ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ডাউকি ফল্টে ৭.৫ বা আরও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে সক্ষম। কারণ ১৮৯৭, ১৯১৮, ১৯২৩, ১৯৩০ সালে সুনামগঞ্জ জেলায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোররাত ৩টা ২৪ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৫ মাত্রা ও একই বছরের ১৪ মে দুপুর ১টা ৪ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৫ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। ভূমিকম্প দুটির উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজভাগ ও সুনামগঞ্জের শাল্লায়। ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৩ মিনিট ২০ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৪, একই দিন দুপুর ২টা ৭ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৪ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। দুটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলই ছিল সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর।
ভূতত্ত্ববিদ ড. মোহাম্মদ সফিকুল ইসলামের দেওয়া তথ্য ও উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ঘনঘন ভূমিকম্প হওয়ায় সুনামগঞ্জ অঞ্চল ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, আবার ঝুঁকি হ্রাস হতে পারে। ডাউকি ফল্টে ১৮৫০ সালের ভূমিকম্পে বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতের ধুবরিতে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। আবার ১৮৯৭ সালে ‘গ্রেট ইন্ডিয়া আর্থকোয়েক’ বা ভারতীয় মহাভূমিকম্প নামে পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময়
১ হাজার ৫৪২ জনের প্রাণহানি রেকর্ড হয়েছিল। শুধু আসাম ও মেঘালয় এলাকাই নয়, ঢাকা শহরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে তখন ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২। ওই ভূমিকম্পে সুনামগঞ্জে ২৮৭ জনের প্রাণহানি হয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভূকম্পনের তিনটি জোনের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা। ওই এলাকার সুনামগঞ্জ, সিলেটের জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্তে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ভূমিকম্প হয় ২৮টি। ২০২৩ সালে ভূমিকম্পের সংখ্যা ছিল ৪১। ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয় ৫৪। এটি ছিল গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সুনামগঞ্জে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বা জনসংখ্যার তথ্যের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখায়। তবে ২০২১ সালে বুয়েটের সহযোগিতায় সরকার ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে একটি সমীক্ষায় শুধু সুনামগঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৯ ভাগ বিল্ডিংকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মূল্যায়ন তথ্য অনুযায়ী ৭৩ শতাংশ জনগণ শিক্ষিত থাকলে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁদের সচেতনতা কম বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এই বছরে দুটি ভূমিকম্প হওয়ায় ঝুঁকি হ্রাসের জন্য করণীয় বিষয়ে সম্প্রতি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. কাজী মতিন উদ্দিনের উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। কর্মশালায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আগাম প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ওই বিশেষজ্ঞ।
ভূমিকম্প নিয়ে দুই যুগ ধরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েকশ বছর ধরে ভূমিকম্পের শক্তি বের না হওয়ায় অনেক শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে ৮ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সমর কুমার পাল বলেন, সুনামগঞ্জে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বা জনসংখ্যার জরিপের কোনো তথ্য নেই। এই জেলায় গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তাই ঝুঁকি হ্রাসের জন্য করণীয় বিষয়ে একজন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে একটি কর্মশালা করা হয়েছে। ওই বিশেষজ্ঞ জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আগাম প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ডাউকি ফল্টের কাছাকাছি সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। তাই সুনামগঞ্জ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সুনামগঞ্জের ভূমিও অনেক নরম, কারণ এই অঞ্চলটি একসময় সাগর ছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অবকাঠামো নির্মাণে বিল্ডিং সেফটি নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। মিস্ত্রি দিয়ে মানুষ ভবন নির্মাণ করে নেয়। যদি বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ভূতত্ত্ববিদ ড. মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডাউকি ফল্টে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে সক্ষম। কারণ এটি একটি সক্রিয় ও বড় জোন। সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চল ও বহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত ডাউকি ফল্টের উপরে অবস্থিত। ভারতের শিলংয়ের দিকে প্লেটটা নেমে যাচ্ছে, যার কারণে এই অঞ্চলে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে ও ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে পড়ছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প হলে যেমন বড় ভূমিকম্পের সংকেত দেয়, আবার শঙ্কা কমতেও পারে। তবে বড় বিষয় হলো সুনামগঞ্জ-সিলেট ডাউকি ফল্টের উপরে অবস্থিত হওয়ায় ঝুঁকি অনেক বেশি। ভূমিকম্পের বিষয়ে সিলেট শহর নিয়ে জরিপ থাকলেও সুনামগঞ্জ অঞ্চল নিয়ে কোনো জরিপ আছে বলে জানা নেই।’ তবে এটা নিয়ে এখনই কাজ করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের সাবেক ডিন এবং ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সুনামগঞ্জ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২১ সালের মাটি ও বিল্ডিংয়ের ভৌত ঝুঁকি নিয়ে একটি মূল্যায়নে সুনামগঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৯ শতাংশ বিল্ডিংকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সুনামগঞ্জ হাওরাঞ্চল হওয়ায় তরলীকরণ (খরয়ঁবভধপঃরড়হ) ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় পানিসিক্ত মাটি হঠাৎ তরলের মতো আচরণ করে এবং ভবন ও রাস্তা ডুবে যেতে পারে বা হেলে পড়তে পারে। ভূমিকম্পের আগাম সতর্কীকরণ ও পূর্বলক্ষণ জানতে সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাঠানো সম্ভব হয়। প্রয়োজনে স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে লাউডস্পিকার ব্যবহার করা যেতে পারে।