অভ্যুত্থানের পরও কেন শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা

গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গুলি করে শ্রমিক হত্যা বন্ধ হয়নি ছবি: সত্যের পথে

গণ–অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। সেই গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গুলি করে শ্রমিক হত্যা বন্ধ হয়নি। ২ সেপ্টেম্বর নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হাবিব ইসলাম (২১) নামের একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। হাবিব ইকু ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি নিটিং কারখানায় কর্মরত ছিলেন।

উত্তরা ইপিজেডের এভারগ্রিন নামের একটি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই এবং বেতন-ভাতা না দিয়ে হঠাৎ কারখানা বন্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন কারখানাটির শ্রমিকেরা। সেনাবাহিনী ও পুলিশ বল প্রয়োগ করে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ইপিজেডের সামনের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ইকু ইন্টারন্যাশনাল কারখানা থেকে নাইট ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরতে থাকা হাবিব ইসলাম নিহত হন।

নিহত হাবিব তো কোনো সংখ্যা নয়, রক্ত–মাংসের মানুষ। তাঁরও তো অনেক আশা–আকাঙ্ক্ষা ছিল। নিহত হাবিবের পিতা বাবা দুলাল হোসেন ছেলে সম্পর্কে সত্যের পথের কাছে বলেছেন, ‘ছেলেটা আমার অনেক ভালো ছিল। খেলাধুলা করি সব সময় ফুর্তিতে থাকত। কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদ নাই। এই সপ্তায় অর নাইট ডিউটি পইড়ছে। এই জন্য দিনত ঘুমায় আর সইন্ধ্যা হইলে রাইতের খাবার খায়া ডিউটিত যায়। কাইল সইন্ধ্যাত এক সাথে রাইতের খাবার খাইছি। কায় জানে বাবার সাথে ওইটাই মোর শেষ খাবার হইবে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হাবিব ইসলামের অকাল ও করুণ মৃত্যুর পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, কারখানার মালিক, বেপজা কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা হয়। সভায় শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবিগুলোর বেশির ভাগ কারখানার মালিকেরা মেনে নেন। ফলে ৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে ইপিজেডের অন্যান্য কারখানা এবং ৬ সেপ্টেম্বর শনিবার থেকে এভারগ্রিন কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

শিল্পাঞ্চলে শ্রম অসন্তোষের সুনির্দিষ্ট কতগুলো কারণ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মজুরি পরিশোধে বিলম্ব, অপর্যাপ্ত মজুরি, ওভারটাইম ও ছুটিসংক্রান্ত অনিয়ম, বেআইনি ছাঁটাই, পাওনা না দিয়েই হঠাৎ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা ও সমস্যা সমাধানের উদ্যোগের অভাবে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত থেকে যায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

দেখা যাচ্ছে, মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টার আলোচনার মাধ্যমে যে সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল, সে সমস্যাটিকে দিনের পর দিন জিইয়ে রাখা হয়েছিল। এভারগ্রিন কারখানায় বেআইনিভাবে শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক দিন ধরেই শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ কাজ করছিল। কিন্তু সেই অসন্তোষের নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের কোনো উদ্যোগ মালিকপক্ষ বা ইপিজেড কর্তৃপক্ষ কারও দিক থেকেই ছিল না। একপর্যায়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলে শ্রম অসন্তোষের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটেছিল।

শ্রমিকের মৃত্যুর পর বেপজা কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে কারখানা মালিক, জেলা প্রশাসন সবাই যে রকম গুরুত্ব দিয়ে শ্রমিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করল, সময় থাকতে এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হলে হাবিব ইসলামকে প্রাণ দিতে হতো না। দেশে শ্রম অসন্তোষের প্রতিকারের যথাযথ প্রক্রিয়া না থাকায় এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে।

বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলেও আমরা দেখেছি বকেয়া মজুরি আদায় বা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামা শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করা হতো। আফসোসের ব্যাপার হলো গণ–অভ্যুত্থানের পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হলো না। শুধু এবারই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এর আগেও গুলি করে শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

সহানুভূতি দেখানোর বদলে বকেয়া মজুরি বা ছাঁটাইয়ের কারণে নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নামা শ্রমিকদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের সুইং অপারেটর কাওসার হোসেন খান এবং অক্টোবরে আশুলিয়ার জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেড কারখানা শ্রমিক চম্পা খাতুনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল।

অথচ এই ধরনের ঘটনা যেন না হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম সংস্কার কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সুপারিশ করেছিল। দেশে সংস্কার নিয়ে কত আলোচনা অথচ শ্রম ও পুলিশ সংস্কারের কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় শ্রম অসন্তোষ ও তার ফলশ্রুতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে শ্রমিক নিহত হওয়া বন্ধ হচ্ছে না।

শিল্পাঞ্চলে শ্রম অসন্তোষের সুনির্দিষ্ট কতগুলো কারণ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মজুরি পরিশোধে বিলম্ব, অপর্যাপ্ত মজুরি, ওভারটাইম ও ছুটিসংক্রান্ত অনিয়ম, বেআইনি ছাঁটাই, পাওনা না দিয়েই হঠাৎ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা ও সমস্যা সমাধানের উদ্যোগের অভাবে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত থেকে যায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। অধিকাংশ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন না থাকায় শ্রমিকদের দর–কষাকষির কোনো সুযোগ থাকে না। শ্রম অধিদপ্তর ও কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের যথাযথ নজরদারি না থাকায় শ্রম আইন প্রতিপালিত হয় না।

শ্রম সংস্কার কমিশন এসব কাঠামোগত ও প্রশাসনিক সমস্যা সমধানের জন্য সুনির্দিষ্ট কতগুলো সুপারিশ করেছে। এ রকম একটি সুপারিশ হলো সমন্বিত অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বা গ্রিভেন্স রিড্রেস মেকানিজম চালু করা। এই ব্যবস্থার অধীনে অনলাইন পোর্টাল, টোল-ফ্রি হটলাইন এবং সরাসরি অভিযোগ কেন্দ্র কার্যকর করার কথা বলা হয়েছিল, যেখান থেকে শ্রমিকেরা সহজে তাঁদের সমস্যা উত্থাপন এবং দ্রুত সমাধান পেতে পারেন।

কমিশন আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যাওয়ার আগেই তার সম্ভাব্য কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া; মালিক-শ্রমিক সংলাপ বাধ্যতামূলক করা; শিল্পকারখানাগুলোতে বেতন-বোনাস, কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে কারখানা পর্যায়ে বড় ধরনের অসন্তোষ তৈরি হওয়ার আগেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতো।

অন্যদিকে পুলিশ সংস্কার কমিশন বিক্ষোভ মোকাবিলার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগের সুপারিশ করেছিল। বিক্ষোভ দমনের ক্ষেত্রে পুলিশ বা সেনাবাহিনী এই নীতিমালা মেনে চললে বিভিন্ন আন্দোলন মোকাবিলায় যে ধরনের ভারসাম্যহীন আচরণের ঘটনা ঘটেছে, সে রকম ঘটত না।

কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ভূমিকাই পালন করছে না, আবার অন্য ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছে। মব সন্ত্রাস দমনে নিষ্ক্রিয় থাকা বাহিনীগুলোই আবার বিভিন্ন অধিকার আন্দোলন দমনে নিষ্ঠুর আচরণ করছে।

অথচ পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে পরিস্থিতি অনুযায়ী ধাপে ধাপে বলপ্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। সংঘবদ্ধ জনতা মিছিল, সমাবেশ বা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার প্রবণতা দেখালে পুলিশ সদস্যরা প্রথমে নিরাপদে দৃশ্যমানভাবে নিয়োজিত হবেন।

যদি জনতা মারমুখী আচরণ করে, ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায় এবং পুলিশ ও সাধারণ জনগণকে আঘাত করে আহত করে, তখন ধীরে ধীরে গ্যাস স্প্রে, সাউন্ড হ্যান্ড গ্রেনেড, জলকামান, গ্যাস বা স্মোক ক্যানিস্টার ও লঞ্চার, হ্যান্ড স্টান ক্যানিস্টার, পেপার স্প্রে, শটগান, ইলেকট্রিক পিস্তল প্রভৃতি ব্যবহার করা যাবে। শুধু আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা যাবে। তবে সেই অধিকারও সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যদিকে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টে সম্পত্তি রক্ষার ক্ষেত্রেও গুলিবর্ষণের সুযোগ না রেখে শুধু আত্মরক্ষার্থে গুলির বিধান রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল।

শ্রম ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সরকার কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে শ্রমিকদের জন্য সমন্বিত অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা কার্যকর করা হলে এবং বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী চললে এভাবে শ্রমিক বিক্ষোভ ও শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটতে পারত না। এত দিনেও এসব জরুরি সংস্কার না করার কারণে জনস্বার্থবিষয়ক সংস্কারে সরকারের আন্তরিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানাতে হলে শ্রম ও পুলিশ সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন ভীষণ জরুরি।

Scroll to Top